মা-বাবার কাছে আর ফিরবেন না আশিকুল
সংসারের দায়িত্ব নিতে বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের তরুণ আশিকুল ইসলাম ওরফে রাব্বির (২০)। কিন্তু বিদেশ যাওয়া আর হয়নি তাঁর। এর আগেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে মারা গেছেন তিনি। একমাত্র ছেলে হারিয়ে এখন মা সামছুন নাহার কেবল কাঁদেন। বাবা আবদুল খালেক সরকারও এ ঘটনায় দিশাহারা।
আশিকুল ইসলামের বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের তারুন্দিয়া গ্রামে। আবদুল খালেক সরকার ও সামছুন নাহার দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে মেজ ছিলেন আশিকুল। তারুন্দিয়া বাজারসংলগ্ন এলাকায় আশিকুলদের বাড়ি হলেও তাঁর বাবা নরসিংদীর মাধবদীতে কাপড় তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। সেই সুবাদে বসবাস করতেন মাধবদীর ভাগীরথপুর মেহেরপাড়া গ্রামে। বাবা আবদুল খালেক কারখানায় কাজ করার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে নিজের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাও চালাতেন। আশিকুল ইসলামও বাবার অটোরিকশাটি চালাতেন।
স্বজনেরা জানান, গত ২১ জুলাই মাধবদী উপজেলায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শেখেরচর মাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সংঘর্ষে মারা যান চারজন। সেদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আশিকুল ইসলামও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মাধবদীর পৌলানপুর ফাজিল মাদ্রাসায় পড়ালেখা করলেও ২০২১ সালে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর লেখাপড়া ছেড়ে দেন আশিকুল। আগামী অক্টোবর মাসে তাঁর ব্রুনেইয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সে জন্য সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছিল পরিবার।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ২১ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মা–বাবার সঙ্গে নাশতা করেন আশিকুল। পরে একসঙ্গে শুয়ে মায়ের সঙ্গে গল্পও করেন। তারপর হঠাৎ বাসা থেকে বের হয়ে যান। তখন বাইরে গন্ডগোল হচ্ছিল। এক বন্ধুর গুলি লেগেছে শুনে ছুটে গিয়ে তাঁকে হাসপাতালে পাঠান আশিকুল। সেখানে থেমে থেমে পুলিশ ও বিজিবির গুলি চলছিল।
আশিকুল ইসলামের মা সামছুন নাহার বলেন, ‘তখন আমার পোলারে ফোন করতে থাকি। তার দুইটা নম্বরেই ফোন করলে অন্য কেউ ধরছিল। তহন বলি, কেলা ফোন ধরো? আমার রাব্বি কই? তহন কোনো কথা নাই, বলে, “ইস্টিশনে আসেন, রাব্বি গুলি খাইছে।” তহন মনডার মধ্যে একটা শক্তি আইল, গুলি খাইলেও তো মানুষ বাঁচে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভিডিওতে দেখেছি, সেকেন্ডের মধ্যে শরীলডা (আশিকুলের) কালা হয়ে গেছে, মটারের পানি ছাড়লে যা হয়, সেইভাবে রক্ত গেছে। আমার ছেলে যহন গুলি খায়, ১৪ জনের মাঝখান থিকা গুলি তার বুকেই লাগে। তখন ভয় পায়া অন্যরা সবাই চইলা যায়। তহন আমার পুত বুকে ধইর্যা মাডিতে পড়ে যায়। ১০-১৫ মিনিট পর লোকজন আইসা হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করে। মাঠে পইড়্যা থাহনের সময়ই আমার পুতরে আল্লায় কবুল কইর্যালছে।’
আহাজারি করে সামছুন নাহার বলেন, ‘আমার একটা ধনই ছিল। এই পোলা নিয়েই কত আশা, কত স্বপ্ন দেখছি। বাপেরে কইতো, “আমি বিদেশে যাইতে পারলে তোমার মেশিন চালাইতে অইতো না।” আমার কী যে ধন ছিল, আল্লায় জানে আর আমি জানি। এর বিচার আল্লায় করবো।’
আশিকুল ইসলামের বাবা আবদুল খালেক সরকার বলেন, ‘ছেলেরে বিদেশে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করছিলাম। সামনের মাসেই বিদেশে যাওয়ার কথা। বুকের ডানদিকে একটা গুলিই লাগছিল। সেই গুলিই সব শেষ করে দিছে।’ তিনি বলেন, ‘মনে করেছিলাম ছেলের লাশ বাড়িত নিয়া আমার আম্মা–আব্বার কবরের পাশে দাফন করবো। কিন্তু সবাই বলছে, নেওয়ার মতো পরিস্থিতি নাই। গন্ডগোলের কারণে অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া যাচ্ছিল না। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো ছিল না। পরিস্থিতি ভালো না থাকার কারণে বাড়িতে নিতে পারি নাই।’
ছেলে হত্যার ঘটনায় আবদুল খালেক বাদী হয়ে নরসিংদী আদালতে একটি মামলা করেছেন জানিয়ে বলেন, ‘আমার কষ্ট কমাবে, এমন আশা ছিল ছেলের। কিন্তু আমারে কষ্টের দরিয়ায় রেখে চলে গেছে সে।’