ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এ দাবি অপমানজনক ও ভিত্তিহীন
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সাম্প্রতিক মন্তব্য, যেখানে তিনি দাবি করেছেন যে মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর সাহসিকতাপূর্ণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করেছিল, তা একদিকে ইতিহাস বিকৃতি, অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আত্মমর্যাদা ও জাতিগত অর্জনের প্রতি চরম অবজ্ঞা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা লাখো শহীদের আত্মত্যাগ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনন্য সাহসিকতার ফসল। অথচ, ভারতের লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যেভাবে পুরো ইতিহাসকে একতরফাভাবে ভারতের জয় হিসেবে চিত্রিত করেছেন, তা শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য অপমানজনক।
মুক্তিযুদ্ধ: বাঙালির আত্মনির্ধারণের সংগ্রাম
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারা দেশের সাধারণ মানুষ জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধে আমাদের প্রধান অস্ত্র ছিল জাতিগত ঐক্য, আত্মনিবেদন, এবং স্বাধীনতার প্রতি গভীর তৃষ্ণা।
ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে মানবিক কারণে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, যা আমরা আজও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু সেই সাহায্যকে যদি আমাদের সংগ্রামের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে প্রচার করা হয়, তবে তা ইতিহাসের প্রতি চরম অবিচার।
ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা: কৃতজ্ঞতা ও বাস্তবতা
ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে এটি কখনোই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চালিকাশক্তি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অনেক সময় স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালির আত্মত্যাগ এবং অবদানকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়।
ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায় এবং ভারতের সামরিক বাহিনী দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু তা কখনোই বাঙালির সংগ্রাম এবং বিজয়ের ভিত্তি হতে পারে না। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর বক্তব্য সেই ঐতিহাসিক সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার একটি প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপোষ নয়
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ একটি গৌরবময় অধ্যায়। এটি বাঙালির আত্মত্যাগ, বীরত্ব এবং স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকারের প্রতীক। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বাঙালির যে স্বাধীন পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আমাদের জাতিগত অহংকার।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর এই মন্তব্যকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অবমাননাকর এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে একটি হস্তক্ষেপ বলেই মনে হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভারতের রাজনৈতিক মাইলফলক হিসেবে চিত্রিত করেছেন, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
মিথ্যাচারের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর বক্তব্য শুধু ইতিহাস বিকৃতির একটি প্রচেষ্টা নয়, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি অংশ। বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির সরকার যখন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ‘ভারতীয় বিজয়’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে, তখন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর এমন বক্তব্য শুধু কংগ্রেসের রাজনৈতিক স্থান পুনরুদ্ধারের একটি কৌশল হতে পারে।
কিন্তু এই ধরনের মিথ্যাচার শুধু বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধই করবে না, বরং দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেও ফাটল ধরাতে পারে।
বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে এই ধরনের ভিত্তিহীন দাবির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের উচিত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় স্পষ্টভাবে জানানো যে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আমাদের একান্ত নিজস্ব অর্জন।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর এই বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক, এবং এটি আমাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত করে। আমাদের ইতিহাস আমাদের গর্ব, এবং সেটি বিকৃত করার যেকোনো প্রচেষ্টা আমরা প্রতিহত করব।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি, আর সেটিকে যারা ভুলভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবে, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যকে তুলে ধরাই হবে আমাদের দায়িত্ব।
লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন
লেখক ও সাংবাদিক