শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
  • সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম:
Verified আই নিউজ বিডি ডেস্ক
প্রকাশ ০৯/১২/২০২৪ ০৮:১৩পি এম

ভারতের আগ্রাসী নীতির কারণে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষের উত্থান

ভারতের আগ্রাসী নীতির কারণে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষের উত্থান
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দীর্ঘ সময় ধরে উত্তেজনাপূর্ণ এবং জটিল। একদিকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, সীমান্ত সংলগ্নতা এবং অভিন্ন ইতিহাস রয়েছে, অন্যদিকে কিছু বিষয় বা ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করে। বর্তমান সময়ে ভারতীয় নীতি এবং কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষ একটি নতুন মাত্রা ধারণ করেছে।

১. সীমান্তের অমানবিক হত্যাকাণ্ড
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (BSF) কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করার ঘটনা একাধিকবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে বাংলাদেশিদের গুলি করা, বিশেষ করে কৃষক ও নিরীহ মানুষদের হত্যা করার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এই ধরনের ঘটনার কারণে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশের জনমনে এক ধরণের ক্ষোভ তৈরি করেছে, যার ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা গভীর হচ্ছে।

২. পানি সমস্যা ও নদী নিয়ে বিরোধ
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হল অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনা। ভারতের কাছ থেকে আসা পানির সঙ্কট, বিশেষ করে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন ইস্যু, বাংলাদেশের কৃষকদের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের বড় একটি অংশ বন্যা ও পানির সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার জন্য ভারতকে দায়ী করা হয়। বাংলাদেশে মনে করা হয়, ভারত গঙ্গা ও অন্যান্য নদীগুলোর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের স্বার্থে, কিন্তু বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশের জন্য তা ক্ষতিকর হচ্ছে।

৩. নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ও এনআরসি
ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (NRC) বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারতের এই পদক্ষেপগুলি বাংলাদেশের মুসলমান জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি করেছে, কারণ এর মাধ্যমে মুসলিম জনগণের জন্য বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই আইনগুলির ফলে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়তে পারে, বিশেষ করে যখন ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে।

৪. ভূমি দাবি ও ঋণ সম্পর্ক
ভারতের প্রতি বাংলাদেশের কিছু মানুষের বিরূপ মনোভাব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে তার ভূমি দাবি ও ঋণ সংক্রান্ত নীতির কারণে। ভারত বাংলাদেশে নিজের খনিজসম্পদ, ভূমি, অথবা জলাধার নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করছে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। বিশেষ করে নদী এবং সীমান্তের কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ভারতীয় নীতির বিরুদ্ধে বিরোধ বাড়ছে।

৫. তথাকথিত 'ঢাকা চুক্তি' এবং কৌশলগত অস্থিরতা
ভারতের কৌশলগত উদ্দেশ্যগত বিভ্রান্তি বাংলাদেশের জনমনে ভারত-বিরোধী মনোভাবকে আরও পোক্ত করেছে। বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে, এবং সেই কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে যে ভারত কখনও আমাদের আত্মনির্ভরতা হুমকির মধ্যে ফেলবে।

৬. আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ভারতীয় ভূমিকা
বাংলাদেশের জন্য ভারত একসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় মনোভাব ও কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ভারত অনেক সময় বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধিতা করে বা বাংলাদেশের প্রয়োজনের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেয় না। ভারতের এই মনোভাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিতর্ক সৃষ্টি করছে।

৭. জনগণের মতামত ও মিডিয়ার ভূমিকা
ভারত-বিরোধী মনোভাব বাংলাদেশে মূলত মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বিশেষ করে যেহেতু সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে, তাই অনেক সময় ভারতের বিরুদ্ধে অবাস্তব তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, যা জনমনে ভারত-বিরোধী অবস্থান গড়ে তুলতে সাহায্য করে। যদিও কিছু প্রগতিশীল ও সুশীল মিডিয়া বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরছে, তবুও ভারতবিরোধী উস্কানি অনেক সময় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে।

৮. ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে যত বেশি হস্তক্ষেপ করবে, ততই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে চাপ তৈরি হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ও রাজনৈতিক মহলে ভারতবিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হচ্ছে, যা দেশের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে এবং তাদের বিদেশ নীতিতে আরও সুনির্দিষ্টতা আনতে হবে।

উপসংহার
ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষ বাড়ানোর কিছু উপাদান রয়েছে, যা একদিকে ভারতীয় নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত, অন্যদিকে বাংলাদেশে গণমাধ্যম এবং জনগণের মধ্যে নানা ভুল ধারণা ও অবিশ্বাস তৈরি করছে। বাংলাদেশের জনগণের মনে ভারতকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব বাড়ানো দীর্ঘমেয়াদে দুই দেশের সম্পর্কের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। ভারতকে এটি উপলব্ধি করতে হবে এবং বাংলাদেশে ভারতীয় কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব বিস্তার না করার চেষ্টা করতে হবে, যাতে দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল ও পারস্পরিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন, লেখক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত সংবাদ