শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
  • সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম:
Verified আই নিউজ বিডি ডেস্ক
প্রকাশ ০৯/১২/২০২৪ ০৮:০৭পি এম

ভারতের আগ্রাসন যত জোরদার হবে, বাংলাদেশে ঐক্য তত মজবুত হবে

ভারতের আগ্রাসন যত জোরদার হবে, বাংলাদেশে ঐক্য তত মজবুত হবে
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ইতিহাসের এক জটিল ও বৈচিত্র্যময় অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ালেও, স্বাধীনতার পর থেকে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন রয়েছে। তবে বর্তমানে যখন ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসছে এবং তার আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তখন বাংলাদেশে দেশের ভেতরে ঐক্য ও জাতীয়তাবোধের যে পরিবর্তন ঘটছে, তা নতুন রাজনৈতিক এবং সামাজিক আলোচনার সৃষ্টি করেছে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ভারত, বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী এবং একমাত্র বড় শক্তি হিসেবে দৃশ্যপটে আসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং মানবিক সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল। তবে, যুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক একেবারে নিখুঁত ছিল না। সীমান্ত সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, ভারতীয় পানি বণ্টন সমস্যা (যেমন গঙ্গা-যমুনা নদী সমস্যা), এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতের কাছে অনুকূল নাও হতে পারে।

এছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন এসব বিষয়গুলোর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে। এই টানাপোড়েন একদিকে যেমন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে, তেমনি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি একটি অনিশ্চিত মনোভাবও তৈরি করেছে।

ভারতের আগ্রাসনের ইঙ্গিত: কূটনৈতিক কৌশল ও সামরিক পদক্ষেপ
ভারত সম্প্রতি তার আঞ্চলিক শক্তি বাড়ানোর জন্য এবং বিশ্বের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আরও দৃঢ় করার জন্য নানা কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভারতের সামরিক বাহিনীর শক্তি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গতিশীলতা তার আঞ্চলিক আধিপত্যের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। তবে, এই শক্তির প্রয়োগ কখনও কখনও প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করে, বিশেষত বাংলাদেশে।

ভারত যখন তার জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়ে। ভারতের এমন আগ্রাসী মনোভাব বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং জাতীয় ঐক্যকে আরো দৃঢ় করে তুলতে পারে। এর ফলে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিরোধী দলগুলো, সরকারের প্রতি জনগণের অনুভূতি প্রকাশ করে এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়।

বাংলাদেশে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের জনগণের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশটির সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা রক্ষা। যখনই বাংলাদেশের ওপর কোনো আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ে বা দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠে, তখন দেশের ভেতরে ঐক্যবদ্ধতা দেখা দেয়। ভারত যদি তার আঞ্চলিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেয়, তখন দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে জাতীয়তাবোধ এবং স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়।

বিরোধী দলের মধ্যে এমনকি সরকার বিরোধী আন্দোলন চলাকালীনও জনগণের মধ্যে ভারতীয় আগ্রাসন এবং বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় একত্রিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঐক্যবদ্ধতা গড়ে ওঠে যখন দেশের সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আসে, যেমনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে হয়েছিল। দেশের জাতীয় ঐক্য তখন শক্তিশালী হয় যখন জনগণ বুঝতে পারে যে, তাদের সম্মিলিত শক্তিই বাংলাদেশকে বিদেশি আগ্রাসন এবং আন্তর্জাতিক চাপের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে।

বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত: আন্তর্জাতিক সমর্থন ও চাপ
ভারত যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের পক্ষে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির, যেমন জাতিসংঘ, চীন, রাশিয়া, এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির সমর্থন বাংলাদেশ পেতে পারে, যদি ভারত কোনও আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়। এই আন্তর্জাতিক সমর্থন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী করে তুলতে পারে এবং দেশটির সামরিক ও রাজনৈতিক অখণ্ডতা রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।

এছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন শক্তি যদি ভারতে হস্তক্ষেপের বিষয়ে মনোযোগী হয়, তাহলে বাংলাদেশ এর থেকে কূটনৈতিকভাবে সুবিধা পেতে পারে। বাংলাদেশ যাতে তার আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে এবং ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানাতে পারে, সেটি আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ভারত-বিরোধী মনোভাব
বাংলাদেশের মধ্যে কখনও কখনও ভারতের প্রতি বিরোধী মনোভাব জাতীয় নির্বাচনের সময়ও উঠে আসে। কিছু রাজনৈতিক দল ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি এক ধরনের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা ভোটাভুটি চলাকালীন, ভারত-বিরোধী বক্তব্য তুলে ধরে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। এই সময় ভারতীয় আগ্রাসন এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।

যতই ভারতের আঞ্চলিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে, ততই বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নটি আরও তীব্র হবে। ভারতীয় আগ্রাসনের ইঙ্গিত বাংলাদেশকে একত্রিত করতে পারে, এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পরিবর্তন আনতে পারে। বাংলাদেশের জনগণ, রাজনৈতিক দলগুলো, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই মুহূর্তে যে পদক্ষেপ নেবে, তা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। দেশের প্রতি জনগণের ভালোবাসা এবং স্বাধীনতার প্রতি তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তাদের ঐক্য গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, যাতে তারা কোনো বিদেশি শক্তির চাপ বা আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।

আব্দুল্লাহ আল মামুন, লেখক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত সংবাদ