এখনও অরিক্ষত বাঁধ, ঝুঁকিতে উপকূলবাসী
১৯৯১ সালে দেশের ইতিহাসে অন্যতম প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায়।
লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছিল দুই উপজেলার কয়েকটি গ্রাম। জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গিয়েছিল অনেক এলাকা। কেবল সরকারি হিসাবে এই ঝড়ে দুই উপজেলার সাড়ে ১৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর কথা জানা যায়। প্রায় সমপরিমাণ মানুষ আহতও হন। চিরতরে ঘরবাড়িহারা হন হাজারো মানুষ। সেই কালরাত্রির নানা ঘটনা এখনো উপকূলীয় এলাকার লোকের মুখে মুখে ফেরে।
তাদের মধ্যে একজন উপকূলীয় এলাকার আবুল কালাম। বয়স তখন ছিল ২৮ বছর। থাকতেন জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের হাজি চাঁদ মিয়া মাঝির বাড়ি এলাকায়। ওই দুর্যোগে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। কিন্তু মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের ৮ সদস্য প্রাণ হারান ঘূর্ণিঝড়ে।
ঘূর্ণিঝড় আঘাতে সাগরের বিলীন হয়ে যায় বসতবাড়ি। পরদিন বাড়ির তিন কিলোমিটার দূরে আদরের কন্যা, তাঁর পিতা-মাতা, দাদা, দাদীসহ পরিবারের ৮ সদস্যের মধ্যে ৬ জনের লাশ দেখতে পান তিনি। টকবকে যুবক সেই শোক বুকে নিয়ে বিবাহিত কামালের ঘরে স্ত্রী, এক কন্যা ও এক ছেলেকে নিয়ে ৩৪ বছর কাটিয়েছেন বোবা কান্নায়।
কিন্তু সেদিনের ভয়ংকর স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেননি তিনি। ওই সময়ের কথা মনে হলে এখনো আতঙ্কে ছেয়ে যায় সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী আবুল কালাম (৬৫) ও তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৫০)। ৩৪ বছর পর এসেও সেই কথা বলতে কেঁপে কেঁপে ওঠেন স্বামী-স্ত্রী দুইজনই। শোকে কাতর হয়ে কামাল ২০১৮ সালে স্ট্রোক করে হারিয়ে পেলেন মুখের কথা বলার শক্তি। নাড়তে পারেন না এক হাতও।
তিনি কথা বলতে না পারলেও সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৫০) ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে তুমুল বাতাস। কোনোরকম গাছে উঠে যাই।’ স্মৃতি হাতড়ে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কান্না সামলে বললেন, ‘ওই ঝড়ে সবাই মারা গেল। শুধু বেঁচে ছিলাম স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে।’
এতবছর কেউ কোনোদিন জানতেও চাইতে আসেনি সেইদিনের ভয়াল ৯১’ই কথা। তিনি বললেন, ‘ঝড়ের কথা শুনলে ভয় লাগে। ঘূর্ণিঝড়ে নিজের চার বছরের কন্যা তানজিনা আকতারকে দাঁত দিয়ে কামড়ে গাছে উঠেছিলাম, মনে করেছিলাম মেয়েটা মরেই গেছে, রাখে আল্লাহ মারে কে, দেখি নড়তেছে মেয়ে। পরিবারের ৮জনকে হারিয়েছি, দুইজনের লাশও পাইনি। কবর দেওয়া হয় কোনো কাফনের কাপড় ছাড়া। এমনদিন যেন আর না আসে।’
প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এলে স্বজন হারানোর কথা স্মরণ করে এখনো শিউরে ওঠেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার উপকূলীয় এলাকার অনেকেই। ওই ঘূর্ণিঝড়ে আনোয়ারায় ১০ হাজার ও কর্ণফুলীতে সাড়ে ৩ হাজার মানুষ মারা যায়। তাদের মধ্যে আনোয়ারার রায়পুর, জুঁইদন্ডী, বারখাইন, বারশত, বরুমছড়াসহ কর্ণফুলীর জুলধার ডাঙারচর ও শিকলবাহা ইউনিয়নে মারা যায় সবচেয়ে বেশি মানুষ। বিলীন হয়ে যায় হাজারো বাড়িঘর ও ফসলি খেত। সেই স্মৃতি এখনো ভোলেননি নিহতদের স্বজনেরা।
তাঁদের দাবি, বেড়িবাঁধ না থাকা ও পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারের অভাবে এ অঞ্চলে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি ঘটেছিল। এখনো টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ও কর্ণফুলী নদীর পানির জোয়ারে এই সব এলাকা প্লাবিত হয় প্রতিবছর। সেই সঙ্গে নেই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র। স্থানীয় বাসিন্দারা ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের ঝুঁকির মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা টেকসই বাঁধ নির্মাণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
বেড়িবাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের স্থান ভেঙে গেছে, এর দুই পাশের মাটি সরে গিয়ে বালু বেরিয়ে গেছে। ওই বালু ঢেউ লেগে ধুয়ে যাচ্ছে। রায়পুরের উপকূলীয় একটি মসজিদের চারপাশে পানি উঠেছে। ওই এলাকায় বিলীন হয়ে গেছে পাশের একটি কবরস্থানও। জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাঁধের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ভাঙন।
ওই এলাকার একাধিক স্থানীয়রা জানান, এই মুহূর্তে জিও টিউব ও জিও ব্যাগের মাধ্যমে আপত্কালীন ব্যবস্থা যদি না নেওয়া হয়, তাহলে এটা দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিসহ বেড়িবাঁধ ভাঙনের ফলে হাজারও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ নিয়ে এলাকায় জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোরশেদুর রহমান খোকা বলেন, ভয়াল দিনের ৩৪ বছরেও উপকূল সুরক্ষিত হয়নি। এখনও উপকূলের রায়পুর ও জুইঁদন্ডী ইউনিয়নের ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত। বিগত সরকারের আমলে বরাদ্দের নামে লুটপাট করেছে। দ্রুত বর্ষার আগে যদি বেড়িবাঁধ মেরামত না করে নুতন করে জুইঁদন্ডী ইউনিয়নের ১ হাজার পরিবার ভাঙনের কবলে পড়বে।
অন্যদিকে কর্ণফুলীর জুলধার ডাঙারচর ও শিকলবাহা ইউনিয়নে বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি ৩৪ বছরেও। পাঁচ কিলোমিটারের অধিক এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় শঙ্কায় বসবাস করছে উপকূলের হাজারো পরিবার। এছাড়াও জুলধা ডাঙ্গারচরে দুর্যোগ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র ও বেঁড়িবাধ এখনো নির্মিত হয়নি। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আতঙ্কে কাটে উপকূলে বসবাসরত প্রায় ২০ হাজার মানুষের।
দুর্যোগকালিন ও পরবর্তী সময়ে করণীয় বিষয় প্রশিক্ষণ দিয়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) ও রেড ক্রিসেন্ট জনসচেতনতা সৃষ্টি করলেও অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে হতাশায় পুরো গ্রামবাসী। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ও দ্রুত টেকসই বেঁড়িবাধ নির্মাণের দাবি উপকূলে বসবাসকারী মানুষের।
৯১ সালের পরই দ্বিতীয়বার ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে প্রলয়ংকরী সুপার সাইক্লোন সিডর আছড়ে পড়ে জুলধা ডাঙ্গারচর উপকূলসহ উপজেলার নদীপাড়ের বসতি গড়া মানুষের উপর। এসময় লন্ডভন্ড হয় মানুষের বসতঘর। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৮-৯ ফুট উচ্চতায় বেড়ে গেলে মানুষের জীবনমান ও চলাচল অচল হয়ে পড়েছিলো তখন।
কর্ণফুলীর জুলধা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম হৃদয় বলেন, সন্ধ্যারপর থেকে বৃষ্টি আর বাতাশ শুরু হয়। রাতে ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। আমরা পাশ^বর্তী একটি সেমিপাকা টিনের ঘরের উপরে ৭০ থেকে ৮০ জন লোক আশ্রয় নিই। সকালে দেখি বিধ্বস্ত এক জনপদ, বিলীন পুরো গ্রাম। লাশ আর লাশ পড়ে রয়েছে চারপাশে। সে এক দুঃসহ স্মৃতি। দুঃখের বিষয় এত বছর এসেও ভয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে উপকূলীবাসিদের। যেন দেখার কেউ নেই। আমরা একটি টেকসই বাঁধের দাবী জানাচ্ছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ২০১৮ সালে সরকার ৫৭৭ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু করে। প্রকল্পে রায়পুর ইউনিয়নের ১৩ কিলোমিটারের মধ্যে ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে পাথরের ব্লক বসানো হয়। বাকি ৫ কিলোমিটার এলাকায় মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ এবং ৫ কিলোমিটারের মধ্যে গহিরা সাগর উপকূলে ২ হাজার ৭০০ মিটার ও সরেঙ্গা শঙ্খ নদীর ২ হাজার ৪০০ মিটারও রয়েছে। এরমধ্যে উপকূলীয় এলাকার বাঁধ নির্মাণে নতুন করে ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবেন বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, ‘বিভিন্ন ভাঙন কবলিত এলাকা গুলোতে জরুরী ভিত্তিতে জিওব্যাগ ও পাথরের বক্ল বসানো হবে। ইতিমধ্যে সরকার নতুন করে উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ নির্মাণের জন্য নতুন করে ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। যেটি বাস্তবায়ন করবেন বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী। আশা করছি শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।’