close
ভিডিও আপলোড করুন পয়েন্ট জিতুন!
কোটা সংস্কার আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সরকারি চাকরির জন্য কোটা ছিল ৫৬ শতাংশ, যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, আদিবাসী কোটা ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী কোটা ছিল ১ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন, অধিকাংশ চাকরিপ্রার্থীই এই কোটা ব্যবস্থার আওতায় পড়েননি এবং তাদের ৪৪ শতাংশ চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করতে হতো। এ থেকেই শুরু হয় কোটা সংস্কারের দাবি, যাতে merit-ভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়।
আন্দোলনকারীরা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল যে, সরকার এই কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠদের বিভিন্ন সরকারি খাতে নিয়োগ দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ ছাত্ররা দেশের বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেছিল। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে তখনকার কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংসদে বলেন, ‘‘যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা কোটা না পায়, তাহলে রাজাকারদের সন্তানরা কি কোটা পাবে?’’ তার এই মন্তব্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে, এবং আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে।
সরকার তখন পুলিশ ও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে। একদিকে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও লাঠিচার্জ করছিল, অন্যদিকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালাত। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নিরস্ত্র ছিল, তবে তাদের ওপর হামলার ফলে অনেকেই গুরুতর আহত হয়। এই হামলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, পরে সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়।
অক্টোবর ৪, ২০১৮-তে সরকার কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেয়। তবে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফেরার পর, ছয় মাস পর হাইকোর্টে কোটা পুনর্বহালের রায় আসে। এ নিয়ে ছাত্ররা পুনরায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আবারো দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সড়ক অবরোধ করে এবং নিজেদের দাবি পূরণের জন্য সরকারের কাছে প্রত্যাশা জানান। সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রীদের বক্তব্য আসে যে, বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন, তাই শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেওয়া হয়।
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই, শেখ হাসিনা কোটা আন্দোলনকারীদের ‘‘রাজাকারদের নাতি’’ বলে আখ্যা দেন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো বেশি ক্ষোভ সৃষ্টি করে। তার এই বক্তব্যের পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা প্রতিবাদী স্লোগান দিতে শুরু করে। এর পর, শিক্ষার্থীরা একযোগে প্রতিবাদ গড়ে তোলে।
এরপর, ছাত্রলীগ আবারো ছাত্রদের উপর হামলা চালায়, এবং সাধারণ ছাত্ররা নিজেদের প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, এবং পুলিশের হস্তক্ষেপে সহিংসতা আরো বৃদ্ধি পায়। ২০১৮ সালের মত আবারো সরকার জনগণের প্রতিবাদ দমন করতে পুলিশের সহায়তায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি চালানো হয়, যার মধ্যে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হন। তার মৃত্যু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে, দেশব্যাপী আন্দোলন আরও তীব্র হয়। ছাত্ররা তখন আন্দোলনে যোগ দেয়।
এ সময় সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয় এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সরকারি ভবনগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করা হয়, তবে ছাত্রদের প্রতিবাদ থামানো সম্ভব হয়নি। এই আন্দোলনটি দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ গণজাগরণ হিসেবে রূপ নেয়।
অবশেষে, আন্দোলনকারীদের চাপে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ৫ আগস্ট, ২০২৪-এ ছাত্ররা ঢাকা অভিমুখে ‘লং মার্চ’ করার ঘোষণা দেয়। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হতে থাকে, এবং শেখ হাসিনার সরকার পতনের দাবিতে জনতা রাস্তায় নেমে আসে। শেষ পর্যন্ত, ১২:২২ PM-এ শেখ হাসিনা গনভবন ছেড়ে চলে যান এবং প্রেসিডেন্টের কাছে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন।
শেখ হাসিনার পতন শুধুমাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফল নয়, বরং ১৫ বছরের সরকারের অত্যাচার, দুর্নীতি, প্রশাসন ও বিরোধী দলের নিপীড়ন, ছাত্রদের উপর দমন-পীড়ন এবং সর্বশেষ তার অহংকার ও গর্বের পরিণতি। বিশ্বের ইতিহাসে এটি প্রমাণিত যে, যখন কোনো শাসক ছাত্রদের গুলি করে, তখন তার পতন সুনিশ্চিত হয়ে যায়।
এই আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। শেখ হাসিনার পতন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক ইতিহাস, যা জনগণের শক্তির সামনে পতন ঘটিয়েছিল।
কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি



















