আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। না আমি নেতা, না আমি কোনো বিচারক। কিন্তু আমার পথচলা আমাকে নিয়ে যায় সমাজের গভীরে—সেখানে, যেখানে আলো পৌঁছায় না, সাহায্যের হাত বাড়ে না, আর অভিযোগগুলোও হারিয়ে যায় বাতাসে।
সামাজিক আর সাংবাদিকতার কাজে আমাকে প্রায়ই যেতে হয় দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়। পাহাড়ি জনপদ, চরাঞ্চল, দুর্গম গ্রামের মাটির ঘর—এসব জায়গায় গিয়েই আমি বুঝি, আমাদের চারপাশে কত মানুষের না বলা কষ্ট জমে আছে।
২০২২ সালের ঘটনা - আমি একটা ভলান্টিয়ার ক্যাম্পিং এ সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলাম, প্রতিদিনের সিডিউল অনুযায়ী আমার/আমাদের ক্যাম্পিং এর দ্বিতীয় দিন দায়িত্ব পড়ে একটা প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের খোঁজ নেওয়ার, বরাবরের ন্যায় আমরা সেই গ্রামে যায়, যাওয়ার পর বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলি, সেখানেই এক নারীর সঙ্গে দেখা। চোখে জল, মুখে নিঃশব্দ আর্তি। তিনি বললেন, “ভাই, আমার ছেলে শহরে গিয়ে গার্মেন্টস্ এর একটা মেয়ে বিয়ে করে আর ফিরে তাকায় না। বিয়ে করে সুখে আছে, আর আমি অন্ধকারে পুড়ছি। তার বাবা বহু আগে মারা যায়।
আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। কারণ, এই গল্প আমি নতুন শুনছি না। এর আগেও বহু মায়ের মুখে এই কথা শুনেছি। কেউ কেউ কাঁদেন, কেউ শুধু নিরবে তাকিয়ে থাকেন।
এমন কত শত গল্প আমার কানে আসে। কিছু বলতে পারি না, কিছু করতে পারি না। কারণ আমি তো প্রশাসন না, বিচারক না। তবুও তাদের কথা শুনি, লেখার চেষ্টা করি, যেন সমাজ একবার হলেও ফিরে তাকায়।
তবে শুধু দুঃখ না, অনেক সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগও পাই। বন্যায় পানি বন্দীদের স্থানীয়দের সাহায্য করে ত্রাণ পৌঁছে দিই। কারও চিকিৎসার জন্য টাকা সংগ্রহে সহযোগিতা করি। কারও শিশুকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারলে মনে হয়, এটাই আমার আসল পুরস্কার।
এইতো সেই দিনের কথা, হঠাৎ আমাদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক সদস্যের মেসেজ, একটা পরিবার এর থাকার বাসস্থান এর অবস্থা খুবই খারাপ, তিন মেয়ে নিয়ে কষ্টে জীবন যাপন করছেন। এই শুনে দেখতে যায়, তাদের অনেক কথা শুনি, পড়ে বিবেচনা করে বাকি সহযোদ্ধাদের পরামর্শ মতে ঘর পুনর্নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বরাবরের মতো আলহামদুলিল্লাহ ঘরের কাজ চলমান।
এই ঘর নির্মাণ এর তাগিদে প্রায় আমার ঐ গ্রামে যাওয়া হয়, অনেকের অনেক কিছু চাওয়া পাওয়া, কিন্তু সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করার ক্ষমতা তো আমার নেই। তবুও তারা বলে আর আমি শুনে যায়।
হঠাৎ একদিন আমি ওখানে ঘর নির্মাণ কালে বাহিরে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছি, কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম কেউ একজন আমার পেছনে দাড়িয়ে আছে, পেছনে ফিরে তাকাতে দেখি আমার মায়ের বয়সী এক মহিলা, তাৎক্ষণিক আমি দাড়িয়ে উনাকে চেয়ারটা এগিয়ে দেয়। কিন্তু উনি উল্টা চেয়ার আমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে, এমন ভাবে আচরণ করছে যেন আমি বড় কোন কর্মকর্তা। তারপরও আমি চেয়ার এ বসতে রাজি নয়, উনি আমাকে বললো আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমি বললাম বলেন। তারপর উনি কান্না সুরে বলতে লাগলেন "দেখেন ভাই আমার স্বামী দীর্ঘদিন আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেন, বর্তমানে উনাকে নিয়ে সংসার করছেন। আমার ৫ ছেলে মেয়ে, বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, দ্বিতীয় মেয়ে গার্মেন্টস্ এ কাজ করেন। ছেলেকে মাদ্রাসায় দিয়েছি, কিন্তু পড়ালেখা করতে চায় না, আমার স্বামী আমাকে মাসে মন চাইলে ২/৩ হাজার টাকা দেয়, এই ছাড়া কোন খরচ দেয় না, আমি ডেইলি কাজ করি, কোমরের সমস্যার কারণে ১ দিন করে আরেকদিন করতে পারি না। গত ৫ বছরে শুধু আমাকে একটা শাড়ি দেয়, এই ছাড়া ঈদেও খোঁজখবর নেয় না। আমার কিছু গরু ছিলো সেগুলো ও সে নিয়ে গেছে।"
আমি নিস্তব্ধ হয়ে উনার কথা শুনে বললাম আমি কি করতে পারি? উনি আমাকে প্রতিউত্তরে বলেন: আপনি আমাকে আমার স্বামীর অধিকার আদায়ের ব্যবস্থা করে দিন, এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যান অনেকবার বিচার করে দিয়েছে, কিন্তু বাসায় আসার পর উনি আগের রূপে ফিরে আসে। আপনি কিছু বললে হয়তো মানবে।
তখন আমি নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করলাম, যেখানে মেম্বার চেয়ারম্যান এর কথা মানে নি সেখানে আমার কথা কেন মানবে? আমি কে? আমি পুরোপুরি নিস্তব্ধ:
আমি কি বলবো খুজে পাচ্ছিলাম না, তবুও উনাকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য বললাম ঠিক আছে দেখি কি করা যায়।
আমি জানি, আমি কোনো বিচারক বা কোন কর্মকর্তা নই। আমি খুব সাধারণ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি—একজন সাধারণ মানুষও সমাজের জন্য কিছু করতে পারে, যদি সে মানুষের কষ্ট বুঝতে শিখে, আর সেই কষ্টের কথা সাহস করে তুলে ধরতে পারে।