যুদ্ধাপরাধ মামলার এক আলোচিত রায়ের পর উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম। প্রতিবাদকারীদের ওপর বর্বরোচিত হামলার ঘটনার প্রেক্ষাপটে এবার মুখ খুললেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান।
তিনি কড়া ভাষায় বলেছেন, দলের কেউ শৃঙ্খলা ভাঙলে কিংবা সংগঠনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কিছু করলে, সংগঠন তার কোনো দায় নেবে না এবং কাউকে কোনো রকম ছাড়ও দেওয়া হবে না।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বিবৃতিতে জামায়াত আমির বলেন,
“দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, সিদ্ধান্ত ও শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে কেউ কিছু করলে সংগঠন তার কোনো দায় নেবে না এবং এ বিষয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে কাউকে কোনো ছাড়ও দেওয়া হবে না। ব্যক্তি তিনি যেই হোন না কেন।”
আজহারুল ইসলামের খালাস, প্রতিবাদ ও হামলার ঘটনা
২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের ছয়টি ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেন।
২০১৯ সালে সেই রায় আপিলেও বহাল থাকে। তবে সরকার পরিবর্তনের পর রিভিউ আবেদনের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (২১ মে) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দেন।
এই রায় ঘিরে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন বামপন্থি ও ছাত্র সংগঠন রাস্তায় নামে, প্রতিবাদ করে।
রাজশাহীতে মশাল মিছিলে হামলা
মঙ্গলবার রাতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো মশাল মিছিল বের করলে সেখানে হামলা হয়। প্রতিবাদকারীদের লক্ষ্য করে লাঠিচার্জ, ধাওয়া ও মারধরের অভিযোগ উঠে।
চট্টগ্রামে প্রকাশ্য হামলা, নারীকর্মীকে লাথি
পরদিন বুধবার, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট আজহারের খালাসের প্রতিবাদে মানববন্ধন করে। সেখানেও সহিংস হামলার ঘটনা ঘটে, যাতে নারীসহ অন্তত ১০ জন আহত হন।
সবচেয়ে আলোচিত হয় একটি ভিডিও, যেখানে এক নারী কর্মীকে লাথি মারতে দেখা যায় একজন যুবককে।
পরে জানা যায়, ওই যুবক ইসলামী ছাত্র শিবিরের সঙ্গে জড়িত।
শাহবাগবিরোধী ঐক্য'র নামে হামলা, দায় এড়াল জামায়াত?
উভয় হামলাতেই অভিযোগ উঠেছে ‘শাহবাগবিরোধী ঐক্য’-র ব্যানারে সংগঠিত কর্মীদের বিরুদ্ধে, যাদের অনেকেই জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সঙ্গে যুক্ত বলে প্রতিবাদকারী সংগঠনগুলোর দাবি।
তবে জামায়াত আমিরের ফেইসবুক বিবৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, দলটি সরাসরি দায় নিচ্ছে না—বরং দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন,
“অতএব সবাইকে দলীয় শৃঙ্খলা, সিদ্ধান্ত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য বজায় রেখে কাজ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এর কোনো ভিন্নতা যেখানেই ঘটুক, সংগঠন অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবে।”
বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
জামায়াতের এমন বিবৃতিকে অনেকে দেখছেন রাজনৈতিক দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে। অপরদিকে, বামপন্থি ও প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর প্রশ্ন, “প্রতিবাদ করা কি এখন অপরাধ? আর হামলাকারীরা কি আদৌ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে, নাকি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়?”
সরকারি পর্যায়ে এখনো এসব হামলার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি, তবে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে।
তদন্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ
প্রতিবাদকারীদের দাবি, ভিডিও ফুটেজ ও ছবি প্রকাশিত হওয়ার পরও প্রশাসন এখনো কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি।
অন্যদিকে জামায়াত এখন নিজেদের শৃঙ্খলার প্রশ্নে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখালেও, মাঠের পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন।
একদিকে যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায়ের খালাস, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে বর্বরোচিত হামলা—এই দুই বিপরীত চিত্র এখন দেশের রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।
জামায়াত নেতৃত্ব চাইলেও, মাঠে তাদের কর্মীদের আচরণ সেই চেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।