দীর্ঘ ২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও বাস্তব রূপ পায়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। পাহাড়ের মানুষ এখনো বঞ্চনার শিকার, তাদের অধিকার আজও প্রশ্নবিদ্ধ। এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রত্যাশা করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
আজ রাজধানীর ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, “পাহাড়ি জনগণের অধিকার হরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, আমলা এবং সামরিক শক্তির মধ্যে একটি অদৃশ্য ঐক্য কাজ করে। এই ত্রিমুখী চাপে বাস্তবতাই হলো—পার্বত্য অঞ্চলের আজকের সংকটময় পরিস্থিতি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান স্পষ্ট করে বলেন, গণমাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে তেমন প্রতিবেদন আসে না। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও গণমাধ্যম কিছু বিশেষ ‘নিয়ন্ত্রণের’ অধীন, যার ফলে এই সংকট বারবার চাপা পড়ে যায়।”
তিনি ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়েও গবেষণার আহ্বান জানান। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শব্দটি নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে—এটি বসতির সময়কাল বোঝায়, না কি জীবনধারা ও সংস্কৃতির পরিচায়ক, তা স্পষ্ট করতে হবে।
চব্বিশের জুলাইয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো হলেও বাস্তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি। নারী ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও পরিবর্তন আসেনি।
তিনি সতর্ক করেন, -যে অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে, তারা আদিবাসী শব্দটিকেই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়—এখানেই বড় চ্যালেঞ্জ।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লড়াই শুধু তাদের নিজস্ব সংগ্রাম নয়, এটা বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকারের প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকতে হবে।
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আদিবাসী অধিকারকর্মী সতেজ চাকমা। তিনি বলেন, -২৮ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। পাহাড়ি জনগণ আজও আতঙ্কে বাস করছে।
সভায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন, “শান্তিচুক্তির পর ২৮ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি মৌলিক প্রতিশ্রুতি। পার্বত্য চট্টগ্রামকে এখনো বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে আনা হয়নি।”
সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, -একটি দেশের সভ্যতা নির্ধারিত হয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর অবস্থানের ওপর। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি বলে দেয় আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের নেতা খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “৫৪ বছরেও সংবিধান, রাষ্ট্রনীতি বা শাসনব্যবস্থায় কোনো ঐকমত্য তৈরি হয়নি। পাহাড়ের শাসন কাঠামো নিয়ে আজও অস্থিরতা চলছে।”
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মন্তব্য করেন, “তিন দশকেও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে একটি ইতিবাচক পথরেখা তৈরি করা। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, “চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের আশাবাদী করেছিল। কিন্তু পরে সেই আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে।” তিনি উল্লেখ করেন, বিগত সরকার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েও বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।
সাবেক এমপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, “চুক্তি বাস্তবায়নের পেছনে বড় বাধা হলো কিছু খারাপ আমলা, রাজনীতিবিদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি। আমাদের সঙ্গে বেইমানি করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে অন্তত একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ দিতে পারে।”
সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসভাপতি অজয় এ মৃ এবং সঞ্চালনা করেন তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা। উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এক সময় ছিল বাংলাদেশের জন্য শান্তির প্রতিশ্রুতি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিশ্রুতি অবহেলায় পড়ে আছে।