বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও দৃঢ় হলো একটি অভূতপূর্ব আর্থিক চুক্তির মাধ্যমে। গতকাল টোকিওতে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে ১.০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বিশাল ঋণ ও অনুদান সহায়তা চুক্তি বিনিময় হয়েছে। এই সহায়তা অর্থনৈতিক সংস্কার, রেলপথ উন্নয়ন এবং উচ্চশিক্ষা খাতে বিশেষ অবদান রাখবে।
কী থাকছে এই ১.০৬ বিলিয়নের মধ্যে?
-
৪১৮ মিলিয়ন ডলার ডেভেলপমেন্ট পলিসি লোন — বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জলবায়ু স্থিতিশীলতায়।
-
৬৪১ মিলিয়ন ডলার রেলপথ উন্নয়নে — জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন প্রকল্পে।
-
৪.২ মিলিয়ন ডলার অনুদান — স্কলারশিপে ব্যবহৃত হবে।
চুক্তিপত্র বিনিময়ের সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, যিনি জানান, এই সহায়তা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ঐতিহাসিক অগ্রগতি
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকে দুই দেশ কৌশলগত অংশীদারত্ব, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে গভীর আলোচনা হয়।
যৌথ বিবৃতিতে উঠে এসেছে—
-
শান্তি ও স্থিতিশীল ইন্দো-প্যাসিফিক গড়তে একসাথে কাজের অঙ্গীকার
-
গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতি
-
জাতিসংঘ সনদের আলোকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার
ড. ইউনূস মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগে জাপানের অব্যাহত সহায়তার প্রশংসা করেন।
ছয়টি বিশাল সমঝোতা স্মারক (MoU): নতুন বিনিয়োগ, নতুন দিগন্ত
‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনার’-এ ড. ইউনূসের উপস্থিতিতে ছয়টি MoU সই হয়, যার প্রত্যেকটি বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে।
১. জ্বালানি খাতে:
জেবিআইসি ও জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় — যৌথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমঝোতা।
২. অর্থনৈতিক অঞ্চল:
অনোডা ইনক ও বিএসইজেড — গ্যাস মিটার কারখানা প্রতিষ্ঠায় জমি লিজ চুক্তি।
৩. গার্মেন্টস খাতে:
বাংলাদেশ নেক্সিস কো. ও বিএসইজেড — গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ কারখানা স্থাপন।
৪. পরিবহণ খাতে:
গ্লাগিট, মুসাসি সিমিতিসু ও বিডা — ই-বাইক ও ব্যাটারিচালিত বাইসাইকেল তৈরির কারখানা।
৫. তথ্য নিরাপত্তা:
কিপার কোর — ২ কোটি ডলার বিনিয়োগে ‘কোয়ান্টাম প্রতিরোধী ডিজিটাল অর্থনীতি’ গড়ার লক্ষ্যে পাইলট প্রকল্প।
৬. সিঙ্গেল উইন্ডো উন্নয়ন:
জাইকা ও বিডা — বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও কার্যকর ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’।
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খাতে বড় ঘোষণা
জাপান সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে পাঁচটি টহল নৌকা দেবে। এছাড়া প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি হস্তান্তর নিয়ে দুই দেশ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে এবং দ্রুত চুক্তি সম্পন্নের আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
‘থ্রি জিরো ক্লাব’ গঠনের ডাক ইউনূসের
টোকিওর সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. ইউনূস এক প্রভাবশালী বক্তৃতায় বলেন,
“আমরা এখন আত্মবিধ্বংসী সভ্যতা গড়ে তুলেছি। তরুণদের থ্রি জিরো ক্লাব গড়তে হবে — শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ।”
তিনি চাকরিকে সৃজনশীলতা দমনকারী বলে অভিহিত করেন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুগে নতুন সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়টি তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে— সামাজিক উদ্ভাবন ও বৈশ্বিক উন্নয়নের স্বীকৃতিস্বরূপ।
জাপানের প্রশংসা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন,
“বাংলাদেশ এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। মাতারবাড়ী কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি দরজা। আমরা নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য সেই দরজা খুলে রাখব।”
জাপানের ভাইস মিনিস্টার তাকেউচি শিনজি বলেন,
“বাংলাদেশ হচ্ছে এশিয়ার কৌশলগত বিন্দু। জাপান বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পাশে থাকবে।”
প্রবাসীদের সঙ্গে মতবিনিময়
জাপানে বসবাসরত শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন,
“বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে প্রবাসীদের ভূমিকা অপরিসীম।”
জাপানের সঙ্গে এই ঋণ ও অনুদান চুক্তি শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্ক নয়, বরং একটি কৌশলগত ও দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্বের পথে বিশাল এক মাইলফলক। রেল, জ্বালানি, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, শিক্ষা — সব খাতে বাংলাদেশ এখন এক নতুন গতি পেতে চলেছে।
🔔 এই চুক্তি কি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ঘুরে দাঁড়ানোর সূচনা? সময়ই দেবে উত্তর। কিন্তু নিঃসন্দেহে, এই দিনটি বাংলাদেশের কূটনীতির ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।



















