close

লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!

গুলি থামলেই যুদ্ধ থেমে যায় না, চলতে থাকে কোষে কোষে

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
ইসরায়েলি হামলায় আহত আহমেদ বাঁচতে পারতো, কিন্তু ওষুধ ছিল না। যুদ্ধ থামলেও ‘সুপারবাগ’ ঘাতকের মতো ছড়িয়ে পড়ছে গাজা থেকে বিশ্বে—শুরু হয়েছে নীরব এক বৈশ্বিক সংক্রমণযুদ্ধ।..

ছয় বছরের ফিলিস্তিনি শিশু আহমেদ উত্তর গাজায় রান্নাঘরে খেলছিল তার ছোট্ট খেলনা গাড়িটি নিয়ে। মুহূর্তেই পাশের ভবনে পড়ে ইসরায়েলি বোমা, জানালার কাঁচ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে বিঁধে যায় তার শরীরে। মা মরিয়ম তাঁকে টেনে বের করেন ধ্বংসস্তূপ থেকে, রক্তে ভেজা হাত নিয়ে ছোটেন হাসপাতালে। কিন্তু আল-শিফা হাসপাতাল তখন মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে – ৫০ জন রোগী এক কক্ষে, নেই পর্যাপ্ত স্যালাইন, নেই রক্ত, নেই জীবাণুমুক্ত সরঞ্জাম। আহমেদের পা ও পিঠে ছিল গভীর কাটা, কিন্তু জীবনের জন্য ততটা নয়—তবে সংক্রমণের জন্য ছিল।

চিকিৎসকেরা জরুরি ভিত্তিতে সেলাই করেন, তবে তিন দিনের মধ্যে তাঁর জ্বর ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। ক্ষত থেকে বের হয় পুঁজ; ধরা পড়ে ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া—অ্যাসিনেটোব্যাক্টর বওম্যানিয়াই। গাজায় এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র অস্ত্র ছিল কোলিস্টিন, কিন্তু সেই অ্যান্টিবায়োটিক ফুরিয়ে গিয়েছিল বা সীমান্তে আটকে ছিল। নার্সরা রক্ত পরিশোধন যন্ত্র হাতে তৈরি করে কোনও মতে ৪৮ ঘণ্টা সময় বাড়ান। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি—আহমেদ মারা যায় ৩:১৭ মিনিটে। মৃত্যুর কারণ লেখা হয়: সংক্রমণ। যুদ্ধের নাম নেই।
এই একটি গল্প অসংখ্য ঘটনার প্রতিফলন—যেখানে ক্ষত নয়, হত্যা করছে হাসপাতালের ভেতর ঘাপটি মারা ব্যাকটেরিয়া।

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা, সিরিয়া ও ইউক্রেনের মতো অঞ্চলে এক নতুন ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়েছে—এটা জীবাণুর যুদ্ধ। শুধু রকেট বা মিসাইল নয়, এবার হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস। যুদ্ধের কারণে হাসপাতাল, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ও ওষুধ ব্যবস্থার ভেঙে পড়া পরিস্থিতি এই “সুপারবাগ”-দের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। এরা এমন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু, যাদের প্রতিরোধ করা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) রিপোর্ট বলছে, গাজায় আহত রোগীদের ৪৭% হাসপাতালে-আর্জিত সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছেন। ৭০% আঘাতজনিত অস্ত্রোপচারে দেখা দিচ্ছে প্রাণঘাতী সংক্রমণ। ডাক্তারদের ভাষায় – গাজা এখন "একটি জীবাণু উৎপাদনকারী কারখানা"।

একসময় শুধু শরণার্থী ছিল মানুষ, এখন সঙ্গে হচ্ছে “শরণার্থী ব্যাকটেরিয়া”। যুদ্ধকবলিত অঞ্চল থেকে মানুষ যখন পালিয়ে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় অদৃশ্য ঘাতকদের—ভয়ঙ্কর সব ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস।

১. বিধ্বস্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থায় কলেরা, হেপাটাইটিস-এ ইত্যাদি মহামারি দেখা দেয়।
২. অভ্যন্তরীণ আশ্রয়কেন্দ্রে ছড়ায় স্ক্যাবিস, যক্ষ্মা, MRSA।
3. অপুষ্টিতে শরীর দুর্বল হয়, সাধারণ সংক্রমণও মারাত্মক হয়ে ওঠে।
4. ভেজাল/মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহারে জন্ম নেয় ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণু।
5. ধ্বংসপ্রাপ্ত টিকাদান কাঠামো ফের ফিরিয়ে আনছে পোলিও ও অন্যান্য রোগ।

ইসরায়েল ও মিসর যুদ্ধের কারণে কোলিস্টিন ও অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী ওষুধ গাজায় প্রবেশে বাধা দেয়, কারণ এগুলো ‘দ্বৈত ব্যবহারের’ আওতায় পড়ে – চিকিৎসায় যেমন প্রয়োজন, তেমনই সামরিক ভয়ে নিষিদ্ধ। WHO বলছে, এর ফলে মৃত্যুহার বেড়েছে ৪০%।

সিরিয়ায় ‘ভৌতিক ফার্মেসি’ নামের কালোবাজারি ওষুধ বিক্রেতারা বিক্রি করছে ভেজাল অ্যান্টিবায়োটিক, যার ফলেই জন্ম নিচ্ছে বহু-ওষুধ-প্রতিরোধী টাইফয়েড ও যক্ষ্মা। ইউক্রেনেও একই ছবি—সেখানে পোল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মধ্যেও এই জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে।

বিশ্বব্যাপী এই জীবাণুরা এখন “ওয়ার জোন পাসপোর্ট” নিয়ে চলাফেরা করছে। সিরিয়ায় দেখা দেওয়া পোলিও পরে ইরাক, লেবানন ও ইসরায়েলেও পাওয়া গেছে। গাজার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে মিশর পর্যন্ত। ইউক্রেনের সংক্রমণ ছড়িয়েছে জার্মানি ও পোল্যান্ডে।

যুদ্ধ শুধু এখনকার মানুষকে মারে না, মেরে ফেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনাকেও। গবেষকরা বলছেন, এই জীবাণুর কারণে মানুষের DNA পর্যন্ত পরিবর্তিত হচ্ছে, বাড়ছে ক্যানসার ও মানসিক রোগের ঝুঁকি। PTSD-এর মতো মানসিক অবসাদ সন্তানদের দেহেও চলে যাচ্ছে।

বিশ্ব এখন প্রশ্ন করছে—গাজার, সিরিয়ার, ইউক্রেনের এই স্বাস্থ্য-সংকট কি একদিন গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করবে?

এই যে ঘাতক জীবাণুদের নীরব আগ্রাসন – তা যুদ্ধের পরিণতি। আর তাই কেবল অস্ত্রবিরতি যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন যুদ্ধ বন্ধের, শান্তির। কারণ শান্তি থাকলে হাসপাতালে সংক্রমণ ছড়ায় না, শান্তি থাকলে শিশু আহমেদরা মারা যায় না।
গাজা, ইউক্রেন, সিরিয়া – এদের মৃত্যু সংবাদ আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য এক সতর্ক বার্তা। সময় আছে, কিন্তু কম। এই নীরব যুদ্ধের সামনে দাঁড়াতে হলে, এখনই দরকার শান্তির অস্ত্র। নইলে পরবর্তী লড়াই হবে আরেকটি শিশুর দেহে—আরেকটি হাসপাতালে—আমাদের শহরে।

No se encontraron comentarios