ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর ফের সহিংসতায় উত্তাল হয়ে উঠেছে। মেইত জাতিগোষ্ঠীর এক প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেপ্তার করায় রাজ্যের কেন্দ্রীয় উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। ৭ জুন শনিবার রাতেই রাজধানী ইম্ফালসহ একাধিক অঞ্চলে শুরু হয় অগ্নিসংযোগ, রাস্তা অবরোধ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ।
শনিবার সন্ধ্যায় কোয়াকেইথেল এলাকা থেকে ওই নেতাকে গ্রেপ্তার করে নিরাপত্তা বাহিনী। এই গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই মেইত সম্প্রদায়ের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ইম্ফালের বিভিন্ন সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে তারা। রাতেই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে কোয়াকেইথেল এলাকায়। এই সংঘর্ষে একাধিক ব্যক্তি আহত হন বলে খবর পাওয়া গেছে।
পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে রবিবার সকালে প্রশাসন পাঁচটি বিভাগে মোবাইল ডেটা ও ইন্টারনেট পরিষেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এই বিভাগগুলো হলো – ইম্ফাল পূর্ব, ইম্ফাল পশ্চিম, কাকচিং, থোবাল ও বিষ্ণপুর। ইন্টারনেট পরিষেবা পাঁচ দিনের জন্য বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
এই প্রথম নয়। মণিপুরে ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, সেসময়ও বড় ধরনের সংঘর্ষের জেরে প্রায় পাঁচ মাস ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল। এতদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও, আবারও অস্থিরতার আগুন জ্বলে উঠেছে। এবারের সিদ্ধান্ত সেই ভয়াবহ সময়ের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।
এই অস্থিরতার মূল উৎস খুঁজে পাওয়া যায় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে, যখন মণিপুর হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায়ে মেইত জাতিগোষ্ঠীকে তফসিলি উপজাতির (Scheduled Tribe) মর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে কুকি ও অন্যান্য পাহাড়ি উপজাতিরা তীব্র আপত্তি জানায়। তাদের দাবি, মেইতরা যদি তফসিলি উপজাতির মর্যাদা পায়, তবে তারা পাহাড়ি এলাকায় জমি কেনার অধিকার পাবে এবং উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত কোটা-তেও ভাগ বসাবে।
এই আশঙ্কা থেকেই রাজ্যজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, যা অল্প সময়েই সহিংসতায় রূপ নেয়। এরপর থেকেই মণিপুর কার্যত দফায় দফায় সহিংসতার কবলে পড়ে। সংঘর্ষের আগুন এখনো পুরোপুরি নেভেনি। বরং মাঝে মাঝেই রাজ্যের একাধিক জায়গায় নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে।
নতুন করে ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জরুরি যোগাযোগ—সবকিছুতেই দেখা দিয়েছে জট। স্থানীয়রা বলছেন, “সাধারণ মানুষের সমস্যা হচ্ছে বারবার। অথচ প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা নেই।”
তবে প্রশাসনের দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং গুজব বা উসকানিমূলক বার্তা ছড়ানো ঠেকাতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে রাজ্যের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে টান টান উত্তেজনা। গ্রেপ্তার হওয়া মেইত নেতা সম্পর্কে এখনও সরকারিভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে মেইত সম্প্রদায়ের দাবি, তাকে অন্যায়ভাবে হয়রানি করা হয়েছে এবং দ্রুত মুক্তি না দিলে বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়বে।
অন্যদিকে, কুকি ও অন্যান্য উপজাতিদের নেতারাও সতর্ক বার্তা দিয়েছেন—“তফসিলি উপজাতির মর্যাদা দিলে পাহাড়ে অশান্তি আরও বাড়বে।” ফলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে কেন্দ্রীয় প্রশাসনেও।
মণিপুর যেন অস্থিরতার গোলকধাঁধায় আটকে গেছে। একের পর এক ঘটনার সূত্র ধরে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজন, ভূমির মালিকানা, সংরক্ষণ কোটা—সবকিছু মিলিয়ে রাজ্যে এখন সময় যেন থমকে গেছে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভারসাম্য রক্ষা। তা না হলে, মণিপুরের আগুন আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে—যার পরিণতি গোটা ভারতের জন্যই হবে ভয়ংকর।