ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলা বিশ্ব রাজনীতির উত্তাপ যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি এর ভয়াবহ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, যা পুরো বিশ্বকে এক নতুন সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
সাম্প্রতিক এই উত্তেজনার সূত্রপাত হয় টানা ১১ দিন ধরে চলা ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক সংঘাত দিয়ে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ মোড় নেয় যখন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শনিবার রাতে মার্কিন বাহিনী ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি হামলা চালায়।
এই ঘটনার পরপরই আন্তর্জাতিক তেলবাজারে নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শুধু একদিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে তেলের ফিউচার দাম হঠাৎ করেই আকাশ ছুঁয়ে ফেলে।
বিবিসি জানায়, মার্কিন অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৩.৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি ব্যারেল ৭৬.৪৭ ডলার। অপরদিকে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্রেন্ট তেলের দামও বাড়ে ৩.২ শতাংশ, গিয়ে ঠেকে ৭৪.৫৯ ডলারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই দাম বাড়ার পেছনে বড় কারণ হলো বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। একদিকে চলমান যুদ্ধ, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ – এই দুইয়ের মিলিত প্রতিক্রিয়ায় তেলের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
এই উত্তেজনার মধ্যে আরেকটি বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে মুদ্রা বাজারে। বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের মান বেড়েছে প্রায় ০.৩ শতাংশ। সাধারণত বিশ্বে যখন রাজনৈতিক বা সামরিক সংকট দেখা দেয়, তখন বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ডলারের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে ডলারের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আদৌ স্থায়ী হবে কিনা – তা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক সংশয়।
সঙ্কটের নতুন মাত্রা যোগ করেছে ইরানের পার্লামেন্ট। গতকাল তারা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের পথ ‘হরমুজ প্রণালি’ বন্ধের অনুমোদন দিয়েছে।
এই প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের প্রায় ২০% তেল সরবরাহ হয়ে থাকে। সেটি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে জ্বালানি সরবরাহে ভয়াবহ বিঘ্ন ঘটবে এবং বিশ্ব অর্থনীতি পড়বে গভীর বিপর্যয়ের মুখে। যদিও এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, তবে অনুমোদনের বিষয়টিই যথেষ্ট শঙ্কার বার্তা দিচ্ছে বাজারকে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও জ্বালানি বাজার চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তেলের দামে এমন উর্ধ্বগতি বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে এবং সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক খাতে তৈরি করবে চরম চাপ।
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে বলছেন, যদি ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করে এবং হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তা হতে পারে ২০২৫ সালের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সূচনা।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এখন আর শুধু মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ নয়—এটি বিশ্ববাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সামনে আরও অস্থিরতা আসছে, যা শুধুমাত্র তেলের দাম নয়, পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকেই টলিয়ে দিতে পারে।