ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে রুখতে গিয়ে ইসরায়েল যখন গোপনে একের পর এক বিজ্ঞানী হত্যা করছে, তখন প্রশ্ন উঠছে—এভাবে কি সত্যিই থামানো যাবে পরমাণু বোমা তৈরির পথ? ইসরায়েলের নিজস্ব রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৪ জন শীর্ষ বিজ্ঞানীকে হত্যা করে তারা প্রকল্পকে ‘কয়েক বছর পিছিয়ে দিয়েছে’। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের মতো রাষ্ট্রে বিকল্প বিজ্ঞানীর অভাব নেই, আর নকশা-পরিকল্পনা একবার তৈরি হলে প্রকল্প থামানো সহজ নয়।
সম্প্রতি ফ্রান্সে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত জোশুয়া জারকা এক বিস্ফোরক দাবি করে বলেন, এই হত্যাকাণ্ড ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে প্রায় অক্ষম করে তুলেছে। ১৩ জুনের একাধিক হামলায় ইসরায়েল ৯ জন বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে, যারা পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা, বিস্ফোরক প্রযুক্তি, ধাতুবিদ্যা ও রসায়নে বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
পরে আহত মোহাম্মদ রেজা সিদিঘিও মারা যান। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই ধরনের হত্যাকাণ্ড প্রকল্পকে থামাতে পারে, না শুধু কিছুদিন দেরি করে?
পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বিশ্লেষক মার্ক ফিটজপ্যাট্রিক স্পষ্ট বলেন, ‘‘এই পরিকল্পনার মূল নকশা রয়ে গেছে, এবং নতুন বিজ্ঞানীরা সহজেই তা শিখে নিতে পারবে।’’ তাঁর মতে, ইরান এতটাই এগিয়ে গেছে যে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির বিজ্ঞানীরাও সফলতার পথে নিয়ে যেতে পারবে। প্রকল্প বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
রাশিয়ার পারমাণবিক বিশ্লেষক পাভেল পডভিগ যুক্ত করলেন, ‘‘মূল বিষয় হলো ইউরেনিয়াম ও প্রয়োজনীয় উপাদান হাতে থাকা। উপাদান থাকলে বিজ্ঞানীকে ভয় দেখিয়ে কেউ খুব একটা কিছু করতে পারবে না।’’
রাষ্ট্রদূত জারকা দাবি করেন, এই হত্যাকাণ্ড দেখে ভবিষ্যতে যারা এই প্রকল্পে যুক্ত হতে চাইবে, তারা ‘দুইবার ভাববে’। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ভয় কৌশল কাজ করবে না। লোভা রিনেল, প্যারিসভিত্তিক বিশ্লেষক, বলেন, ‘‘বিজ্ঞানী হত্যা ইরানকে থামাতে পারেনি, শুধু সাময়িক বিলম্ব করেছে।’’
আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন পডভিগ—‘বিজ্ঞানী হত্যার এই পথ কি ভবিষ্যতে পদার্থবিদ্যা পড়া ছাত্রদেরও হত্যার দিকে যাবে? এটা এক বিপজ্জনক উদাহরণ।’
মানবাধিকার আইনের দৃষ্টিতে সাধারণ বেসামরিক নাগরিক হত্যা নিষিদ্ধ। বিজ্ঞানীরা যদি সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নেন বা সামরিক বাহিনীর সদস্য না হন, তবে এই হত্যা আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। তবে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন আর. ডেভিড মনে করেন, যেহেতু তারা এমন এক শাসকের পক্ষে কাজ করছিলেন যে ইসরায়েল ধ্বংসের হুমকি দিয়েছে, তাই তারা বৈধ লক্ষ্যবস্তু।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি হাউজ অব কমন্সে বলেন, ‘‘কয়েক দশকের জ্ঞান কোনো হামলা মুছে ফেলতে পারে না। এমনকি বোমা ফেলে হলেও তা মুছে দেওয়া অসম্ভব।’’
রাষ্ট্রদূত জারকা যদিও বলেন, এই বিজ্ঞানীরা কেবল পড়াশোনা করেননি, তারা তা ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহারের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাই তারা বৈধ টার্গেট।
ইসরায়েল চাচ্ছে একটি পরমাণু ইরানকে থামাতে। তবে যেভাবে তারা বিজ্ঞানীদের হত্যা করছে, তা বিশ্ববাসীর সামনে এক নৈতিক প্রশ্নও তুলে ধরছে—‘একজন বিজ্ঞানী কি শুধুই যন্ত্র?’ আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—“জ্ঞান কি গুলিতে মারা যায়?” ইতিহাস বলছে—না।
		
				
			


















