close

লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!

বেনাপোল কাস্টমসে ‘ঘুসের খনি’: কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি ও দুর্নীতির ভয়াল চিত্র!..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
বেনাপোল কাস্টমসে দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট! পিয়ন থেকে কমিশনার পর্যন্ত সবাই ঘুসে নিমজ্জিত—ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য, শুল্ক ফাঁকি আর ভয়ভীতি ছড়িয়ে চলছে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম। একাধিক চালানে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর..

পুরো নিউজ রিপোর্ট (2+ পৃষ্ঠার বিস্তারিত):

বেনাপোল কাস্টমসে দুর্নীতির রাজত্ব: ঘুসের বিনিময়ে শুল্ক ফাঁকির মহোৎসব!

যশোরের বেনাপোল কাস্টমস হাউজ যেন এখন দুর্নীতি আর ঘুস বাণিজ্যের দুর্গে পরিণত হয়েছে। সরকারি রাজস্ব আদায়ে দায়িত্বরত এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটি আজ অসাধু কর্মকর্তাদের অভয়ারণ্যে রূপ নিয়েছে। কাস্টমস কমিশনার মো. কামরুজ্জামান ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এই দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। অভিযোগ উঠেছে—পিয়ন থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘুসের চক্রে জড়িত। আর এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা, যারা অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকার পণ্য খালাস করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

ডকুমেন্ট আসার আগেই দর-কষাকষি!

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোনো আমদানি ডকুমেন্ট কাস্টমসে পৌঁছানোর আগেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেন-দরবার শুরু করে দেন। ‘মূল ভ্যালুর কত শতাংশ নগদ দিতে পারবেন’—এই হিসেবেই নির্ধারিত হয় একটি চালানের ভাগ্য। আর বেশিরভাগ সময়েই শুল্কের অর্ধেক অর্থ ঘুষ হিসেবে দিয়ে ব্যবসায়ীরা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য খালাস করে থাকেন।

যেসব ব্যবসায়ী ঘুস দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদেরকে দেওয়া হয় ‘শাস্তি’—পণ্যের ভ্যালু বাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, ভুল এইচএস কোড, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ। বাধ্য হয়েই ব্যবসায়ীরা কাস্টমস কর্মকর্তাদের শর্তে রাজি হন। এর ফলে সরকার হারায় কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।


একটি চালানে ৫টি নিষিদ্ধ পণ্যের গোপন খালাস!

২০২৪ সালের ২৪ মার্চ বেনাপোল বন্দরে ‘শাফা ইমপেক্স’ নামে এক আমদানিকারক ভারতের ‘আরএস এন্টারপ্রাইজ’ থেকে পণ্য আনেন। চালানে ১২৬২টি প্যাকেজ এবং ৪৮টি পণ্যের নাম ছিল। এর মধ্যে পাঁচটি পণ্য ছিল পরীক্ষাযোগ্য—যেমন: সার্জিক্যাল ও আইসিইউ ইকুইপমেন্ট, মেডিকেল টেস্ট কীট, অস্থিসংক্রান্ত (অর্থোপেডিক) পণ্য এবং কেমিক্যাল। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয়—মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে একদিনের মধ্যেই এই সব পণ্য পরীক্ষা ছাড়াই খালাস করে দেওয়া হয়!

এই ঘটনা শুধু একটি উদাহরণ, এমন অসংখ্য চালান প্রতিনিয়ত খালাস হচ্ছে, যেখানে পরীক্ষা, যাচাই-বাছাইয়ের বালাই নেই।


চট্টগ্রামে ধরা পড়ল বেনাপোলের ‘বোনাস পণ্য’!

২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি বিজিবি চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটে এমআর ইন্টারন্যাশনালের দুটি ট্রাক আটক করে। বেনাপোল থেকে আসা এই চালানে ছিল অতিরিক্ত ৬,৫০০ কেজি পণ্য—যেগুলোর ঘোষণা ছিল না!

তদন্তে পাওয়া যায়:

  • নাট-বল্টু: ৬,০৮০ কেজি

  • মাইক্রো রিলে: ১,৫০০ পিস

  • মিউজিক্যাল হর্ন: ২৪০ কেজি

  • লং হোস পাইপ: ১১০ কেজি

  • বেল্ট পলি পাইপ: ১৮.৮৯ কেজি

  • গিয়ার সিম সেট: ২৮ কেজি
    এছাড়া বিপুল পরিমাণ মেডিসিনও ছিল, যেগুলো পরে সরিয়ে ফেলা হয়।


বন্ড সুবিধায় দুই কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি!

১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বন্দরের ৪২ নম্বর শেডে এক চালানে মিথ্যা ঘোষণায় প্রায় দুই কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়ে। ‘শিশির নিটিং’ নামের গাজীপুরের একটি প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধার নামে ফেব্রিক্স (শার্টিং-স্যুটিং কাপড়) আমদানি করে।

ঘোষণায় বলা হয়—গার্মেন্টস বন্ডের আওতায় পণ্য এসেছে, যার জন্য শুল্ক দিতে হয় না। কিন্তু বাস্তবে আমদানি করা হয়েছে ফেব্রিক্স, যার শুল্ক প্রায় ২ কোটি টাকা! কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চালানটি জব্দ করে। তবে শোনা যায়, কাস্টমস কমিশনারকে ৪০ শতাংশ ঘুষ দিতে রাজি হয়েছিল আমদানিকারক। টাকা আগে না পৌঁছানোয় চালানটি আটক করা হয়।


‘ঘুষ না দিলে হয়রানি’—সিঅ্যান্ডএফ নেতার অভিযোগ

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন নেতা বলেন—“আমরা সরকারের রাজস্ব আদায়ে সহযোগিতা করি। কিন্তু বেনাপোল কাস্টমসে এখন হয়রানিই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি ফাইলে ভয়ভীতি, ভুল এইচএস কোড, বাড়তি শুল্কের ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায় করা হচ্ছে।”

তিনি আরও জানান—নিচের পর্যায়ের স্টাফরা ফাইল নেওয়ার সময় ৫০-৬০ হাজার টাকা ঘুষ চায়, আর উপরের কর্মকর্তাদের জন্য ফাইলে লাগে তিন থেকে চার লাখ টাকা!


‘অভিযোগ ভিত্তিহীন’ বলছেন কাস্টমস কমিশনার

এই ব্যাপারে কাস্টমস কমিশনার মো. কামরুজ্জামান জানান—“এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেউ যদি প্রমাণসহ অভিযোগ দেয়, আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।”

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—যেখানে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, সেখানে তদন্ত হবে কার অধীনে?


শেষ কথা: কবে থামবে এই দুর্নীতির মহোৎসব?

বেনাপোল কাস্টমসে একের পর এক শুল্ক ফাঁকি, ঘোষণাবহির্ভূত চালান, মেডিকেল সরঞ্জামের অপব্যবহার, এইচএস কোড নিয়ে প্রতারণা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক বিশাল ফাঁক তৈরি হচ্ছে। কেবলমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করলেই থামতে পারে এই দুর্নীতির মহোৎসব।

আরও জানুন, আরও শেয়ার করুন—দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান!

Inga kommentarer hittades