close

লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!

বাংলাদেশের যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার যুগান্তকারী পরিবর্তন..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
বেদে সম্প্রদায়, যারা শতাব্দী ধরেই যাযাবর জীবন যাপন করে আসছে, আজ তারা বদলে যাচ্ছে। নদীর তীর থেকে ডাঙ্গায় উঠে তারা স্থায়ী বসতি গড়ে সমাজের সঙ্গে মিশতে চাইছে। শিক্ষায় আগ্রহী, ব্যবসায়িক ও কর্মসংস্থানে জড়িত..

বাংলাদেশের যাযাবর জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম প্রান্তিক এবং ভাসমান জীবন যাপনের পরিচয়বাহী ‘বেদে’ সম্প্রদায়। প্রথাগতভাবে নদী পথে জীবন কাটানো এ জনগোষ্ঠীকে স্থানীয়ভাবে ‘বাইদ্যা’ নামে ডাকা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এরা নদী ও ঘাটের ওপর নির্ভরশীল ছিল, নানা কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারনায় আবদ্ধ থেকে জীবন যাপন করত। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে আজকের বেদে সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রায় এসেছে বিশাল পরিবর্তন।

প্রখ্যাত সুরকার আবু তাহেরের গানে উঠে এসেছে বেদেদের সেই মুক্ত যাযাবর জীবন — “মোরা এক ঘাটেতে রান্দি বাড়ি, মোরা আরেক ঘাটে খাই, মোদের সুখের সীমা নাই…”। তবে এই জীবনের স্বাধীনতা আর নেই আজকাল। নদীর জীবন ছেড়ে ডাঙ্গায় স্থায়ী বসতি গড়ে তারা সমাজের মূলধারায় আসার চেষ্টা করছে।

মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার পালরদী নদীর তীরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি বেদে পরিবার এখন নদী থেকে উঠে ডাঙ্গায় স্থায়ী বসতি গড়ে নিয়েছে। এদের জীবনযাত্রায় আগের কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত চিকিৎসা ভাবনা অনেকটাই কমে এসেছে। শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে পড়ছে বেদে তরুণ-তরুণীরা। পুরুষরাই এখন বাড়তি উপার্জনের দায়িত্ব নিয়েছে, আর নারীরা পরিবার-পরিচর্যায় বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।

একসময়ের যাযাবর বেদেরা এখন ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিভিন্ন পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে। তারা সচেতন হচ্ছে, আধুনিক জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। তবে সমাজের মূল স্রোতে মেশা তাদের জন্য সহজ কাজ নয়। অনেক সময় তারা চোখে আলাদা ভাবে দেখা হয়। বেদে সর্দার মনির হোসেন জানান, সমাজ এবং সরকার যদি তাদের জন্য চাকরীর নিশ্চয়তা ও জীবনমান উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তাদের জীবন আরও বদলে যেতে পারে।

বেদে সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন না হলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাদের জীবনের মান উন্নত করতে পেশাগত বিকল্প এবং আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। তবেই সম্ভব হবে বেদেদের জীবনযাত্রায় স্থায়ী পরিবর্তন।

বেদে সম্প্রদায় তাদের জীবনের প্রায় শতকরা বেশির ভাগ সময় নদীর ওপর ভাসমান বাড়িতে কাটাত। এরা ছোট নৌকায় ভ্রমণ করে বন্য মাছ ধরে বেঁচে থাকত। তাদের জীবন ছিল নির্ভরশীল প্রকৃতির ওপর, যাযাবর জীবনের ছন্দে। এদের মধ্যে পুরুষেরা শিকার ও মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত থাকত, আর নারীরা ঘরদোর সামলাত। চিকিৎসায় অনেক সময় কুসংস্কারপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণ করত।

বর্তমানে এদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষার প্রসারে বেদেদের অনেক সন্তান এখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারনা থেকে মুক্তি পেয়ে তারা আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ করছে। পেশা পাল্টে এখন তারা ব্যবসা, কৃষি এবং চাকরির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।

ডাঙ্গায় উঠে স্থায়ী বসতি গড়ার ফলে বেদে সম্প্রদায়ের সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে। তারা নিজেদের মধ্যে সহায়তা ও সহযোগিতার মাধ্যমে নতুন সমাজ গঠন করছে। যদিও এখনও সমাজের মূলধারায় সম্পূর্ণ একীভূত হতে পারেনি বেদেরা, তবে তাদের জীবনযাত্রার উন্নতির লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে।

বেদে সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কার্যকর নীতিমালা ও সমাজের সহযোগিতা। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেদে জনগোষ্ঠীর শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, পেশাগত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দরকার। চাকরির নিশ্চয়তা ও সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রা উন্নত করা সম্ভব।

সর্বোপরি, বেদে সম্প্রদায়কে সমাজের মূল স্রোতে টেনে আনার জন্য জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। বেদেদের প্রতি সমাজের ইতিবাচক মনোভাব ও সহনশীলতা তাদের উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করবে।

বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায় আজ বদলে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তারা যাযাবর জীবনের স্বপ্নকে একটু পিছনে রেখে আধুনিক সমাজের নতুন পথে পা বাড়াচ্ছে। শিক্ষায় অগ্রগতি, পেশা পরিবর্তন ও স্থায়ী বসতি তাদের জীবনে নতুন আলো যোগাচ্ছে। তবে তাদের সম্পূর্ণ সমন্বয় ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমাজ ও সরকারের একযোগে সহযোগিতা।

বেদে সম্প্রদায়ের এই পরিবর্তনের গল্প শুধু তাদেরই নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়নেরও গল্প। একযোগে এগিয়ে গেলে সম্ভব হবে বেদেদের জীবনমানের উন্নতি এবং বাংলাদেশ হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ।

Nenhum comentário encontrado