উদ্যোক্তাদের আস্থার অভাব শিল্প উৎপাদনকে প্রভাবিত করছে, ঢাকা চেম্বার..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
ব্যাংকখাতের নৈরাজ্য, ঋণ খেলাপি ও উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতায় শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে—সংস্কার ছাড়া উত্তরণ অসম্ভব বলে সতর্ক করলো ঢাকা চেম্বার।..

দেশের শিল্প খাত এক ভয়াবহ আস্থাহীনতার সংকটে ভুগছে। ব্যাংকিং খাতের অস্বচ্ছতা, বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ এবং সুদের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা। এমন পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতে আমূল কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া শিল্পোৎপাদনের গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।

শনিবার (২৮ জুন) ডিসিসিআই-এর অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ: ঋণ গ্রহীতার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে অর্থনীতির শীর্ষ ব্যক্তিরা এ বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “বর্তমানে দেশের আর্থিক খাত নানা প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত। এ খাতে অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণ আদায়ে ধীরগতি ও সুদের উচ্চহার—এসব মিলে উদ্যোক্তাদের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।” তিনি জানান, ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে খেলাপি ঋণ ৪.২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা অনাদায়ী ঋণের ২৪%। এই চিত্র অর্থনৈতিক নৈরাজ্যকেই প্রতিফলিত করে।

এ সময় তাসকীন আহমেদ জানান, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে ৭.৫ শতাংশে নেমেছে, যা শিল্পোৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মূল্যস্ফীতিও ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, ফলে উদ্যোক্তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, “ঋণদাতা ও গ্রহীতা—দুই পক্ষেরই দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। আর্থিক ও মুদ্রানীতির মধ্যে কার্যকর সমন্বয় ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।”

তিনি আরও বলেন, সুদের হার ব্যাংকগুলো নিজেরা চাইলে কমাতে পারে, এতে এসএমই উদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে পারেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ইজাজুল ইসলাম বলেন, “বিগত সময়গুলোতে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সেই অস্বচ্ছতা কাটিয়ে উঠতে হবে।” তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে ৪২ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। তার মতে, বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল হলে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে।

ডিসিসিআই-এর প্রাক্তন সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, “সুদহার বেড়ে যাওয়ার ফলে ২০২৫ সালে উদ্যোক্তাদের ১.৩৯ ট্রিলিয়ন টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হবে। এটা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য মৃত্যুর সমান।”

তিনি আরও বলেন, গ্যাস সরবরাহ সংকটে শিল্প উৎপাদন ৫০% কমে গেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আমদানি বাধা, ডলারের অস্থিরতা ও টাকার অবমূল্যায়ন। এসবের প্রভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ।

ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা বলেন, দেশের ১৪টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৪০ শতাংশের কাছাকাছি, যেখানে ৪৭টি ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকে সেটি মাত্র ৫-৭ শতাংশ। এর ফলে শুধু ব্যাংক খাত নয়, সম্পূর্ণ শিল্পব্যবস্থাই ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

হোসেন খালেদ (আনোয়ার গ্রুপ), বলেন, “এসএমইরা হচ্ছে বড় শিল্প উদ্যোক্তাদের সাপ্লাই চেইনের অংশ। বৃহৎ উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো ইকোসিস্টেমেই ভাঙন ধরবে।

আব্দুল হাই সরকার (বিএবি চেয়ারম্যান) বলেন, “আইএমএফ বা অন্যান্য সংস্থার সাথে সরকারের যোগাযোগ থাকলেও বেসরকারিখাত প্রায় অদৃশ্য। এতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হন।”

তিনি জানান, খেলাপি ঋণ আদায়ে আইন প্রয়োগে দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। অর্থঋণ আদালতের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় কম, ফলে বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়।

ফজলে শামীম এহসান বলেন, ডলার রেট বাড়লেও উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ সুবিধা কমছে। এসএমইরা ঋণ বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

সোহানা রউফ চৌধুরী (র‌্যাংগস মোটরস) বলেন, “এত বেশি সুদের হারে উৎপাদন চালানোই কষ্টকর। বৈদ্যুতিক গাড়ি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে স্বল্পসুদের তহবিল চাই।

মতিউল হাসান (মার্কেন্টাইল ব্যাংক) বলেন, “ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ গঠন সময়ের দাবি।”

তিনি জানান, গ্যাস সংকটে কারখানাগুলো চালু রাখা যাচ্ছে না। ফলে ঋণ পরিশোধে অনেকে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছেন। 

বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বেসরকারি খাতের শক্তিশালী ভূমিকা ছাড়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধার অসম্ভব। সে জন্য ব্যাংকখাতের স্বচ্ছতা ও নীতিনির্ধারণী গতি বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে, কার্যকর সংস্কার ও দ্রুত বাস্তবায়নই একমাত্র পথ।

No comments found


News Card Generator