আবারও উত্তাল ইউরোপের এক প্রান্ত—সার্বিয়া। রাজপথে নেমে এসেছে লাখো মানুষ। রাজধানী বেলগ্রেড জ্বলছে সরকারবিরোধী আন্দোলনের আগুনে। প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিচের পদত্যাগ, আগাম নির্বাচনের ঘোষণা এবং গ্রেপ্তারকৃত আন্দোলনকারীদের মুক্তি—এই তিনটি মূল দাবিকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরিত হয়েছে আন্দোলন।
গত শনিবার (২৮ জুন) থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ রীতিমতো রূপ নিয়েছে একটি জনঅভ্যুত্থানে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সার্বিয়ার নানা শহরে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনের মুখ্য নেতৃত্বে থাকলেও তাতে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, চাকরিজীবী, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকরাও।
শনিবারের বিকেলে রাজধানী বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সহিংস সংঘর্ষ বাধে। ধাতব ব্যারিকেড, আবর্জনার ডাস্টবিন এবং লোহা-বাঁশ দিয়ে তৈরি প্রতিরোধ গড়ে তোলে আন্দোলনকারীরা। পুলিশের পিপার স্প্রে, লাঠিচার্জ এবং ঢালও আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইট, বোতল, পাথর ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে আন্দোলনকারীরা।
সংঘর্ষে ৪৮ জন পুলিশ ও ২২ জন বিক্ষোভকারী আহত হন। এখন পর্যন্ত ৭৭ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৮ জন এখনো পুলিশি হেফাজতে। রবিবার দিনে মধ্যেই আরও ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সার্বিয়ার উত্তরের শহর নভি সাদে শাসকদল ‘সার্বিয়ান প্রগ্রেসিভ পার্টি’র কার্যালয়ের সামনে ডিম ছুঁড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিক্ষোভকারীরা। পাশাপাশি, সাভা নদীর গুরুত্বপূর্ণ সেতু ও প্রধান প্রধান সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন রাজধানীবাসী। সংবাদমাধ্যম জানায়, সার্বিয়ার অন্যান্য ছোট শহরেও একই ধরনের সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ চলছে।
রবিবারের আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল শনিবার গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র এবং পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে।
তবে আন্দোলনকারীরা বলছেন, “এই সরকারই দেশের প্রকৃত বিপদ। তারা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, বাকস্বাধীনতা হরণ করছে, আর আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চায়।
রবিবার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিচ এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ‘সহিংস ষড়যন্ত্রকারী’ আখ্যা দিয়ে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন,সবাইকে শনাক্ত করা হচ্ছে। আরও গ্রেপ্তার হবে। কেউ পার পাবে না।
তিনি আরও দাবি করেন,তারা ইচ্ছাকৃতভাবে রক্তপাত ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু সার্বিয়া জিতেছে। এই ধরনের সহিংসতা দিয়ে কেউ সার্বিয়াকে ধ্বংস করতে পারবে না।
এই চলমান আন্দোলনের সূচনা গত বছরের নভেম্বরে। তখন নভি সাদে একটি নবনির্মিত রেলস্টেশনের ছাদ ধসে পড়ে ১৬ জন নিহত হন। অভিযোগ ওঠে, নির্মাণ কাজে দুর্নীতি, সরকারি অব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ছিল। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে জমতে থাকে জনগণের ক্ষোভ, যার বিস্ফোরণ ঘটেছে এখন।
ভুচিচ সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পেতে চেষ্টা চালালেও রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে। পশ্চিমা বিশ্ব ইতিমধ্যেই ভুচিচের বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী শাসন, দুর্নীতি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের অভিযোগ তুলেছে।
বিশ্লেষকদের মতে,এক দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে ভুচিচ আরও কঠোর ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠেছেন। এ আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক স্বাধীনতার দাবিও।
এই মুহূর্তে সার্বিয়া যেন বারুদের স্তুপে বসে আছে। প্রেসিডেন্ট ভুচিচের কড়া মনোভাব, শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ, সাধারণ মানুষের অসহায়তা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সব মিলে একটি বড়সড় রূপান্তরের দিকে এগোচ্ছে দেশটি।
আগামী কয়েকদিনে এই আন্দোলন আরও বিস্ফোরক রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এখন সার্বিয়ার রাজপথে, যেখানে তরুণদের হাতে গড়ে উঠছে এক নতুন ইতিহাস।