রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা অব্যবহৃত এবং অস্বাভাবিক—এমনটাই মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। সম্প্রতি ঢাকা সেনানিবাসে এক অফিসার্স অ্যাড্রেস অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নিজের বক্তব্যে এই বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং সতর্ক করেন, দেশের স্বার্থে নির্বাচন ডিসেম্বরেই সম্পন্ন করতে হবে। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে মানবিক করিডর, নিরাপত্তা সংস্কার, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতিসহ একাধিক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।
সেনাপ্রধান স্পষ্ট করে বলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সার্বভৌমত্ব বিনষ্টকারী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়াবে না এবং কাউকে তা করতে দেবে না।” তিনি তাঁর বাহিনীর সদস্যদের নিরপেক্ষ থেকে, ভবিষ্যতের জাতীয় নির্বাচনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন।
বিশিষ্ট নাগরিক, সামরিক বিশ্লেষক ও সাবেক আমলারা বলছেন, সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. সাব্বীর আহমেদ মন্তব্য করেন, “সেনাবাহিনীকে অন্ধকারে রেখে নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্ত দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এর ফলে বাড়তে পারে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও বিভাজন।”
তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রের সংস্কারেও সেনাবাহিনীর মতামত গ্রহণ করা উচিত ছিল। এটা কেবল সম্মান নয়, রাষ্ট্রচিন্তার অংশ। সংস্কারে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের প্রয়োজন থাকলেও, তাদের বাদ দিয়ে সংস্কার হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ।”
দেশি-বিদেশি চক্রান্ত নিয়ে সেনাপ্রধানের শঙ্কা
সেনাপ্রধান তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, দেশের অভ্যন্তর ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু মহল চায় না বাংলাদেশ চলমান সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাক। “অগাস্ট থেকে আমাকে ও সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে কিছু মহল অপপ্রচারে লিপ্ত। এসব ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে হবে,” বলেন তিনি।
জাতীয় নির্বাচন, মানবিক করিডর, বন্দর নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার—এইসব প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, “আমার সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। সিদ্ধান্তগুলো কোথা থেকে আসছে, সেটাও পরিস্কার নয়। এ ধরনের উদ্যোগ একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই আসা উচিত, বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।”
সংস্কার নয়, বিভাজনের নীলনকশা!
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, “সরকারের কিছু উদ্যোগ প্রমাণ করে সশস্ত্র বাহিনীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে। এটি রাষ্ট্র পরিচালনায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে।”
তিনি আরও জানান, “নির্বাচন যদি ডিসেম্বরের মধ্যে না হয়, তাহলে সুশাসনের পথ রুদ্ধ হবে। সেনাবাহিনীকে দীর্ঘ সময় মাঠে রাখারও কুফল রয়েছে। সংবিধান ও পেশাগত ভারসাম্য রক্ষায় তাদের দ্রুত ক্যাম্পে ফেরানো দরকার।”
মব ভায়োলেন্স ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের বার্তা
‘মব ভায়োলেন্স’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান জানান সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, “আইনের শাসন বজায় রাখতে যা যা দরকার, সেনাবাহিনী তা করবে। কেউ বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে না।”
রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, “সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তিতে। সেনাবাহিনী কখনোই এককপক্ষীয় সিদ্ধান্তে সমর্থন দেবে না।”
সেনাপ্রধানের বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া
সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দেশের শীর্ষ সামরিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, “ন্যাশনাল পাওয়ারের সব উপাদান একত্রে ব্যবহারের মাধ্যমেই জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব। কাউকে বাদ দিয়ে, বা উপেক্ষা করে কোনো অর্জন টেকসই হবে না।”
নির্বাচন, সংলাপ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
সেনাপ্রধানের ভাষণে বারবার উঠে এসেছে নির্বাচন, ঐক্য এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রসঙ্গ। তাঁর মতে, নির্বাচিত সরকারই পারে জাতির জন্য গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরবে, অন্যথায় সংকট আরো জটিল হবে।
তিনি বলেন, “আমি সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বলয়ে ঢুকতে দেব না। এটা আমার স্পষ্ট অঙ্গীকার। অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করছি এবং করব, তবে এর বাইরে কিছু নয়।”
উপসংহার
সেনাপ্রধানের বক্তব্য কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের অংশ নয়—এটি একটি স্পষ্ট রাষ্ট্রচিন্তা, যেখানে নিরাপত্তা, নির্বাচনী স্বচ্ছতা এবং জাতীয় ঐকমত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাঁর বক্তব্য শুধু সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য নয়, সমগ্র জাতির জন্য একটি বার্তা—রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা, সম্মিলন এবং শ্রদ্ধা অপরিহার্য।
নির্বাচন হোক সময়মতো, হোক একটি ঐক্যমতের মাধ্যমে—তবেই রক্ষা পাবে দেশের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ।