সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ বাতিলের দাবিতে টানা ছয়দিন ধরে সচিবালয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সোমবার (২৩ জুন) সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করেন তারা, যা পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাস্তবায়ন হয়েছে।
এই কর্মসূচির আওতায় তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সচিবালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন এবং সেখানে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিচতলায় সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে শুরু হওয়া বিক্ষোভে বিপুলসংখ্যক কর্মচারী অংশ নেন এবং পরে তারা সচিবালয়ের বিভিন্ন লেন প্রদক্ষিণ করে মিছিল করেন।
বিক্ষোভের সময় আন্দোলনরত কর্মচারীরা দফায় দফায় স্লোগান দেন:
-
"অবৈধ কালো আইন মানি না, মানব না"
-
"আমাদের দাবি মানতে হবে, মানতে হবে"
-
"আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই"
-
"আপস না লড়াই, লড়াই লড়াই"
-
"সারা বাংলার কর্মচারী এক হও, লড়াই করো"
এই বিক্ষোভের পেছনে রয়েছে সম্প্রতি সরকার কর্তৃক জারিকৃত ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’, যা ২৫ মে ঘোষিত হয়। এই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা চারটি শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ করলে বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধুমাত্র কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে। এই ধারাকে অবিচার ও একপক্ষীয় বলে মনে করছেন আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারী কর্মচারীদের অভিযোগ, এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকার কার্যত সরকারি চাকরিজীবীদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়া হরণ করছে। তারা বলছেন, কোনো অপরাধের প্রমাণ ছাড়াই একজন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলে সেটি এক ধরনের ‘প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা’।
ঈদুল আজহার পর থেকে সচিবালয়ের কর্মচারীরা এই আন্দোলন শুরু করেন। প্রথমদিকে এক ঘণ্টার প্রতীকী কর্মবিরতির মাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু হয়। এরপর ধাপে ধাপে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও মিছিলের পাশাপাশি উপদেষ্টাদের স্মারকলিপিও দেওয়া হয়।
গতকাল রোববার সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ শেষে কর্মবিরতির ঘোষণা দেন সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান মো. নূরুল ইসলাম।
চাকরি অধ্যাদেশ নিয়ে কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর, ভূমি সচিবের নেতৃত্বে কয়েকজন সচিব মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে কর্মচারীদের দাবি তুলে ধরেন। পরে প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিষয়টি পৌঁছে গেলে ৪ জুন আইন উপদেষ্টাকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয় অধ্যাদেশটি পর্যালোচনার জন্য।
তবে আন্দোলনকারীদের দাবি, এই কমিটি এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো সুপারিশ না দেওয়ায় আন্দোলনের বাস্তবিক অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। ফলে তারা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
সচিবালয়ের কর্মচারীদের এই আন্দোলন ইতিমধ্যে ঢাকার বাইরে অন্যান্য সরকারি দপ্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মকর্তারাও "কলমবিরতি" পালনের ঘোষণা দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটতে পারে, যার প্রভাব পড়বে সাধারণ জনগণের সেবার উপরও।
সরকার একদিকে শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও কমিটির মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিলেও আন্দোলনরত কর্মচারীরা এখনই তাদের দাবিতে ছাড় দিতে রাজি নন। তারা ঘোষণা দিয়েছেন, অধ্যাদেশ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে।
এখন দেখার বিষয়, সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়—কাজেই উত্তেজনার মধ্যেই অপেক্ষা চলছে একটি সমাধানের, যাতে প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে পারে এবং কর্মচারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়।