সাহস, সংগ্রাম আর সৃষ্টিশীলতার এক বিরল গল্পের নাম জাফর পানাহি। দুই দশকেরও বেশি সময় পর সরাসরি অংশ নিলেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে, আর ফিরেই যেন আলোড়ন তুললেন বিশ্ব সিনেমার ভুবনে। ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট’ সিনেমার জন্য হাতে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার— স্বর্ণপাম।
কিন্তু এ অর্জন শুধুই ব্যক্তিগত সম্মান নয়। এটি এক জাতির জন্য এক সাহসী শিল্পীর বার্তা। রাষ্ট্রের কড়া নজরদারি, গ্রেপ্তার, জেল ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার ছায়া মাথায় নিয়েও যিনি থেমে যাননি, লুকিয়ে বানিয়েছেন চলচ্চিত্র, তুলে ধরেছেন সমাজের অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো।
পানাহির সিনেমা: প্রতিবাদের নিরব ভাষা
‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট’— নামটি শুনতে নিরীহ হলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ইরানিদের বাস্তবতা, নিপীড়নের ছায়া ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের গল্প। দীর্ঘ সময় পর কান শহরে এসে সেই গল্প নিয়েই মঞ্চে উঠলেন পানাহি। ৬৪ বছর বয়সী এই চলচ্চিত্রকার বললেন,
"আমরা কী পরবো, কীভাবে বাঁচবো— তা যেন আর কেউ আমাদের না বলে দিতে পারে। স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমাদের এক হতে হবে।"
তিনি আরও বলেন,
"মতের অমিল থাকুক, পথ আলাদা হোক— কিন্তু আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে।"
পানাহি স্পষ্ট বার্তা দেন: ইরানিদের বিভক্তির দিন শেষ। এখন সময় ঐক্যের, সময় একসঙ্গে দাঁড়ানোর।
কান উৎসবে আবেগঘন মুহূর্ত
শনিবার, ২৪ মে, স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় কানের পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে যখন পানাহির হাতে তুলে দেওয়া হয় স্বর্ণপাম, তখন গোটা থিয়েটার দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় তাকে। পুরস্কার তুলে দেন অস্ট্রেলিয়ান তারকা কেট ব্ল্যানচেট। পাশে ছিলেন বিচারক দলের প্রধান ফরাসি অভিনেত্রী জুলিয়েট বিনোশ। আবেগে আপ্লুত পানাহির চোখ তখন ঝলমল করছিলো।
এসময় তার পাশে ছিলেন জীবনসঙ্গিনী ও কন্যা। একইসঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সিনেমার সহ-অভিনেতা– বাহিদ মোবাশ্বেরী, মরিয়ম আফসারী, ইব্রাহিম আজিজি, হাদিস পাকবাতেন এবং দেলনাজ নাজাফি।
সিনেমা— এক প্রতিরোধের ভাষা
জাফর পানাহি বলেন,
“সিনেমা নিজেই একটি সমাজ। এটি কেবল গল্প নয়— এটি প্রতিবাদ, এটি প্রতিরোধ, এটি আশা।”
তার চোখে সিনেমা একমাত্র মাধ্যম যেখানে ভয় না পেয়েও সত্য বলা যায়। যেখানে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ভিত কাঁপানো যায় শিল্প দিয়ে।
একজন নির্মাতার জয়, একটি জাতির বার্তা
জাফর পানাহির এই জয় শুধু একটি সিনেমার নয়। এটি ইরানের জনগণের প্রতি একটি বার্তা— সাহসের, সংহতির এবং স্বাধীনতার। বহু প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যিনি আজ বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলতে পারেন, তার কণ্ঠস্বর এখন শুধুই একজন নির্মাতার নয়, একটি জাতির অজেয় স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব।