নতুন এক সামরিক অধ্যায়ের সূচনা যেন ঘটে গেছে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে। আজ নবম দিনে গড়ালেও সংঘাতের গতি শ্লথ তো হয়নি বরং বেড়েছে ধ্বংসের ভয়াবহতা ও কৌশলের জটিলতা। যুদ্ধের সূচনা লগ্ন থেকে ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা চালিয়ে গেলেও পাল্টা জবাব দিতে পিছপা হয়নি তেহরান। তবে এবার ইরানের প্রতিক্রিয়ায় এসেছে রণকৌশলের এক দৃশ্যমান পরিবর্তন — যা অনেক বেশি নিশানাভেদী, মারাত্মক এবং কৌশলগতভাবে ভয়ংকর।
ইরানের এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা সিএনএন-কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানান, এখন আর আগের মতো গণহারে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে মারছে না ইরান। বরং তারা ব্যবহারে এনেছে এমন ক্ষেপণাস্ত্র, যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। এসব ক্ষেপণাস্ত্র শুধু টার্গেট ভেদ করছে না, বরং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যূহের গভীরে ঢুকে পড়ছে — যেন রাডার ও প্রতিরক্ষা ঢালের মুখেও ভীতিহীন এক আঘাত।
ইসরায়েল অবশ্য দাবি করেছে, তাদের চালানো বিমান হামলায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সক্ষমতার অন্তত ৫০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু ইরান এই দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলছে, মজুত ফুরিয়ে যাচ্ছে এই প্রচারণা চালিয়েই তারা ইসরায়েলকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। প্রকৃতপক্ষে, এখন যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইরান ব্যবহার করছে সেগুলোর প্রতিটি একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর সমান ধ্বংসক্ষমতা ধারণ করে।
ইসরায়েলি সেনা বাহিনী নিজেও স্বীকার করেছে যে, ইরান এমন কিছু ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করছে, যেগুলো ক্লাস্টার বোমা বহন করতে সক্ষম। এই বোমাগুলো আকাশে নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে বিস্ফোরিত হয়ে যায় বহু টুকরোতে, এবং ৮ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে — যেন মৃত্যু নেমে আসে পুরো এক জনপদের ওপর।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এসব ক্ষেপণাস্ত্র ডেভিড’স স্লিং, প্যাট্রিয়ট, থাড, অ্যারো ২/৩ এমনকি আয়রন ডোম — এইসব মার্কিন ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির জটিল ব্যারিয়ার ভেদ করে প্রবেশ করছে। এ যেন প্রযুক্তির চোখে চোখ রেখে আঘাত হানার এক নতুন যুগের সূচনা।
ইরানি সামরিক সূত্র আরও জানিয়েছে, এই মুহূর্তে ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং ‘লক্ষ্যপূরণের ক্ষমতা’ দিয়ে ইরান যুদ্ধ করছে। তারা বার্তা দিচ্ছে— ‘আমরা কম ছুঁড়ব, কিন্তু একবারেই মেরে ফেলব।’
গত আট দিনে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। ইসরায়েলের অভ্যন্তর থেকেই সাধারণ মানুষ ট্রাম্পকে আর্জি জানাচ্ছে— “ইরানকে দমন করো।” প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহায়তা কামনা করেছেন। তিনি চান, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই যুদ্ধে জড়াক।
তবে ট্রাম্প নিজে এখনই সরাসরি হামলা চালাতে রাজি নন। তিনি জানিয়েছেন, অন্তত আরও দুই সপ্তাহ সময় প্রয়োজন কৌশলগত প্রস্তুতির জন্য। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান গতিতে যদি ইরানের হামলা অব্যাহত থাকে, তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যেই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা অব্যবস্থা একেবারে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক টিকে থাকার শেষ রাস্তা এখন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে আনা। কিন্তু ট্রাম্পের ধীর গতি নেতানিয়াহুর হিসেব-নিকেশে বড় এক ধাক্কা।
ইসরায়েলি পত্রিকা Haaretz-এর প্রবীণ কলামিস্ট গিডিয়ন লেভি এ বিষয়ে বলেন, “এই সংঘাতে দুই সপ্তাহ মানে একটি রাজনৈতিক চিরন্তনতা। সময়ই সবকিছু বদলে দিতে পারে।
ইরান আর আগের মতো নেই। তারা শুধু প্রতিরোধ করছে না, বরং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা দিয়ে যুদ্ধের নিয়মটাই বদলে দিচ্ছে। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি গোটা বিশ্ব এখন তাকিয়ে— কখন কোথায় আঘাত হানে ইরান, আর কীভাবে প্রতিরোধ হার মানে আগ্রাসনের।



















