বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম আপিল বিভাগে খালাস পাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ যেন পরিণত হয় জামায়াতের নেতাকর্মীদের তীব্র আবেগ আর ধর্মীয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কেন্দ্রে। রায়ের পরপরই তারা এনেক্স ভবনের সামনে সমবেত হয়ে আদায় করেন দুই রাকাত শোকরানা নামাজ।
সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে আজহারের আপিল গ্রহণ করে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস প্রদান করেন। এই রায় বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এই প্রথমবার কোনো যুদ্ধাপরাধ মামলায় আপিল বিভাগের রায় পরবর্তী রিভিউ শুনানির মাধ্যমে একজন আসামি সম্পূর্ণ খালাস পেলেন।
আদালতে আজহারের পক্ষে শুনানি পরিচালনা করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্র পক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হক এবং প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন গাজী এমএইচ তামিম।
রায় ঘোষণার সময় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাসুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদের সদস্য মোবারক হোসেন, মাওলানা আব্দুল হালিম, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান ও মাসুদ সাঈদী।
এছাড়াও জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন মহানগর উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, দক্ষিণ শাখার নায়েবে আমির হেলাল উদ্দিন ও দেলোয়ার হোসেন। রায়ের পর নেতারা একে ‘ন্যায়বিচারের বিজয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং একে আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে ঘোষণা দেন।
শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, এই রায় দেশের বিচার ব্যবস্থার একটি নতুন নজির স্থাপন করল বলে মত দিয়েছেন আইন বিশ্লেষকরা। যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলোর ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে যে ধারা ছিল, এই রায় তা থেকে এক ধরনের বিচ্যুতি তৈরি করল এবং ভবিষ্যতের জন্য নতুন প্রশ্নের জন্ম দিল।
এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় গণহত্যাসহ একাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। তবে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আজ তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খালাস পেলেন।
এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, তারা আইনের প্রতি সম্মান রেখেই দীর্ঘদিন এই মামলা লড়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত ‘সত্যের বিজয়’ হয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
এটিএম আজহারের খালাস শুধুই একজন ব্যক্তির মুক্তি নয়, বরং এটি বাংলাদেশের আইনি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি জটিল ও বহুমাত্রিক ঘটনা। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে শোকরানা নামাজ আদায়ের দৃশ্য কেবল ধর্মীয় কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি একটি রাজনৈতিক বার্তাও বহন করে—যা দেশের বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।