ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংস আন্দোলন ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘিরে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে এবার বাংলাদেশ সরকারের একটি কূটনৈতিক বক্তব্য ঘিরে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা থেকে একটি কড়া বার্তা দেওয়া হলে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে দিল্লি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট ভাষায় বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ এবং ‘লোক দেখানো’ উল্লেখ করে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক বিবৃতিতে বলেন,
"আমরা ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে আহ্বান জানাই যেন সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার মুসলিমদের ওপর যেসব হামলা হয়েছে, তার নিন্দা জানায়।"
তবে বাংলাদেশের এমন প্রতিক্রিয়াকে মোটেও সহজভাবে নেয়নি ভারত। শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শ্রী রণধীর জয়সওয়াল এক বিবৃতিতে জানান,
"পশ্চিমবঙ্গে যা ঘটেছে তা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের এই মন্তব্য সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক ও ছলনামূলক। তারা একটি সচেতন প্রচেষ্টা করছে, যাতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নিপীড়নের সঙ্গে ভারতের পরিস্থিতিকে তুলনা করা যায়।"
তিনি আরও বলেন,
"বাংলাদেশে যেসব অপরাধী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত, তারা এখনো খোলা মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার বরং নিজেদের সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় মনোযোগ দিক।"
এই মন্তব্য ভারত সরকারের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হলে, তা ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে উত্তপ্ত বিতর্ক শুরু হয়। অনেকেই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
▶️ ঘটনার পেছনের পটভূমি: কী ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গে?
পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় সম্প্রতি নতুন ওয়াকফ আইন সংশোধনের প্রতিবাদে এক বিশাল বিক্ষোভ শুরু হয়। আইনটির বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়, যাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য জেলাতেও।
মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হুগলি জেলায় বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে আসে। সড়ক অবরোধ, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং কিছু এলাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এতে পুলিশ বাহিনী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করে। কয়েকটি এলাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন উত্তাপ?
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। কিন্তু সম্প্রতি কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা ইস্যুতে একে অপরের বিরুদ্ধে মন্তব্য করাকে অনেকেই ‘সতর্ক সংকেত’ হিসেবে দেখছেন।
একজন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন,
“এ ধরনের মন্তব্য ও পাল্টা বিবৃতি দু’দেশের জনগণের মনোভাবেও প্রভাব ফেলতে পারে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন দায়িত্বশীল কূটনৈতিক ভাষা ও সংলাপ সবচেয়ে জরুরি।”
সংযমেই শান্তি
পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই কূটনৈতিক টানাপোড়েনের ভবিষ্যৎ কী—তা এখন সময়ই বলে দেবে। তবে দুই দেশের সরকারের দায়িত্বশীল ও পরিপক্ব আচরণই পারে ভবিষ্যতের জটিলতা এড়াতে। এরকম সময়ে একে অপরের ‘ঘাড়ে দোষ চাপানো’র চেয়ে বরং একসাথে কাজ করাটাই বেশি জরুরি।