রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র প্রেসক্লাবের সামনের সড়ক রোববার (২২ জুন) সকালেই যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সনদ প্রদানের দাবিতে চলা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নেয় উত্তপ্ত বিক্ষোভে। সকাল ১১টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শত শত চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী জড়ো হন। তাঁরা দাবি তোলেন—সব ভাইভা-প্রার্থীকে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ দিতে হবে।
তবে আন্দোলনকারীদের এগিয়ে যাওয়া রুখে দেয় পুলিশ। সকাল ১১টার দিকে তাদের সামনে বাধা তৈরি করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বারবার সরে যেতে বললেও বিক্ষোভকারীরা জোর স্লোগানে অটল থাকেন—“ভাইভা বঞ্চনার বিচার চাই!”। পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ঠিক ১১টা ২৩ মিনিটে পুলিশ জলকামান চালায় এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে হাহাকার, দৌড়ঝাঁপ, কান্না। অনেকেই রাস্তার পাশে আশ্রয় নেন, কেউবা পানিতে ভিজে জড়ো হন কাছের ফুটপাতে।
চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় আতঙ্ক ছড়ায় সাধারণ পথচারীদের মাঝেও। ভিডিও ধারণ করতে ব্যস্ত অনেকের ক্যামেরা কাঁপছিল পুলিশি অ্যাকশনের শব্দে।
আন্দোলনকারীদের ভাষ্য অনুযায়ী, এবারের ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের ভাইভা পরীক্ষা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত। প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও রেকর্ডসংখ্যক—২০ হাজার ৬৮৮ জন প্রার্থী—ফেল করেছেন মৌখিকে। আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
তাঁদের মতে, ভাইভায় অংশ নেওয়া সকলকেই ন্যায্য মূল্যায়ন না করে, অবিচার ও পক্ষপাতমূলকভাবে ফল তৈরি করা হয়েছে। এই বিষয়ে আন্দোলনকারীরা ১৫ জুন এনটিআরসির (NTRCA) সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। সেখানেও দাবি ছিল একই—ভাইভা দিতে আসা সবাইকে সনদ দিতে হবে।
উপস্থাপিত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ফলাফলে বিশাল তারতম্য রয়েছে। কোনো বোর্ডে ৩০ জনের মধ্যে ২৯ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন, আবার অন্য কোনো বোর্ডে ৩০ জনের মধ্যে পাস করেছেন মাত্র ১ জন। এই প্রবণতা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—
১৬তম শিক্ষক নিবন্ধনে পাশের হার ছিল ৯২.১৫%
১৭তম পরীক্ষায় ৯৫.০২%
কিন্তু ১৮তমে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৭৪.৫২%
আরো উদ্বেগজনক হচ্ছে— আরবি বিষয়ের ভাইভায় পাশের হার ছিল ৫৩.৪৭%, আর সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ৫২.১% মাত্র!
এই বিপর্যয়কর হারের কারণ কী? চাকরিপ্রত্যাশীদের মতে, এবারের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন ছিল অসাধারণ কঠিন। প্রশ্নে ছিল না কোনো বিকল্প অপশন, এমনকি অনেক প্রশ্ন ছিল বিভ্রান্তিকর।
আন্দোলনকারী যুবকদের মতে, শিক্ষক নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ভাইভায় এমন অসমতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তোলে। তাঁরা বলছেন— “আমরা দিনের পর দিন প্রস্তুতি নিয়েছি, হাজারো কষ্ট করেছি। অথচ ভাইভা বোর্ডে আমাদের কথাই শোনা হয়নি। কিছু বলা বা ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি।”
চূড়ান্তভাবে আন্দোলনকারীদের একটাই দাবি— ভাইভায় অংশ নেওয়া প্রত্যেককেই যেন শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ প্রদান করা হয়। তারা এও বলেছেন, যতদিন দাবি পূরণ না হবে, ততদিন আন্দোলন চলবে। পুলিশের জলকামান বা গ্রেনেড আন্দোলনের সুর নষ্ট করতে পারবে না।
এই ঘটনায় আবারো প্রশ্ন উঠেছে—বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াগুলো কতটা স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হচ্ছে? যখন হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থী বছরের পর বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে এসে এমন হতাশা বয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান, তখন সে রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর আস্থা টিকে থাকে না।



















