জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে চলমান সংলাপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ের একটিতে—প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ—রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে স্পষ্ট বিভাজন। কারও প্রস্তাব দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ, আবার কেউ বলছেন বারবার বিরতি দিয়ে হলেও একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ খোলা রাখা উচিত। এই বিতর্কমূলক ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি দেশের বড় ও ছোট রাজনৈতিক শক্তিগুলো।
রোববার (২২ জুন) সকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় সংলাপের দ্বিতীয় ধাপের পঞ্চম দিনের আলোচনা। মূলত এই অধিবেশনেই উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ মেয়াদ সংক্রান্ত প্রস্তাবনাগুলো।
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “গণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ করা উচিত হবে না। আলাদা আলাদা আলোচনা করে যদি আমরা সমাধানে পৌঁছাতে না পারি, তাহলে সংস্কারের লক্ষ্যই ব্যর্থ হবে। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রের কোনো বিভাগকে অকার্যকর করে দিলে সেটা হবে ভারসাম্য নষ্ট করা। দুই মেয়াদ হোক, পাঁচ বছর হোক—এটা আলোচনা করে নির্ধারণ করা উচিত। তবে হাত-পা বেঁধে দিলে সেটা হবে স্বৈরাচার ঠেকাতে গিয়ে নতুন সীমাবদ্ধতা তৈরি করা।”
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ সর্বোচ্চ দুইবার থাকা উচিত। তবে সেটি অবশ্যই পূর্ণ মেয়াদের হতে হবে। কেউ যদি মেয়াদ পূর্ণ না করতে পারে, তবে সেটা নতুন করে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।”
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে তুলনামূলক নমনীয় অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, “প্রধানমন্ত্রী পরপর দুইবার হবেন। এরপর একবার বিরতি দিয়ে পুনরায় দুইবার হবেন। যতবার খুশি, ততবার হতে পারবেন। তবে প্রতি দুইবার পরপর একটি বিরতির শর্ত রাখতে হবে।”
একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আমজনতা দলের কার্যনির্বাহী সদস্য সাধনা মহল। তিনি বলেন, “এক ব্যক্তি পরপর দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। এরপর একবার গ্যাপ দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।”
এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদও একই অবস্থানে রয়েছেন। তিনি বলেন, “একজন ব্যক্তি পরপর দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এরপর একবার বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকবে।”
তবে কিছু রাজনৈতিক দল মেয়াদ নির্ধারণে কঠোরতা চায়। ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, “ঐকমত্যের স্বার্থে আমরা সর্বোচ্চ দুইবারের পক্ষে। তবে সংকটের মূল জায়গা হচ্ছে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায়—বিশেষ করে নিম্নকক্ষের নির্বাচনী পদ্ধতি। এটি সংস্কার না করলে মেয়াদ নির্ধারণে সুবিধা হবে না।”
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, “মেয়াদ পূর্ণ না করাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিতর্ক আছে। তবে সেটি বাদ দিলে আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে—প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুইবার হওয়া উচিত। এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পথ।”
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধতা আমরা সমর্থন করি। সেভাবেই সিদ্ধান্তে আসা উচিত বলে মনে করি।
জাতীয় ঐকমত্য গঠনের এই উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণের ইস্যুটি যে কতোটা বিভক্তির জন্ম দিতে পারে, তা আজকের সংলাপেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। কেউ চাইছেন গণতন্ত্রের নামে বারবার সুযোগ পাওয়ার রীতি বহাল রাখতে, কেউ আবার চাইছেন সংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকাতে।
তবে একটি ব্যাপারে সবাই একমত—নির্বাচন ও ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে হলে এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বরং স্পষ্ট, নির্দিষ্ট ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই ইস্যুতে আরও একাধিক দফা আলোচনা হবে। চূড়ান্ত সুপারিশে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ে একটি সম্মত মডেল তৈরির লক্ষ্যে কাজ চলছে।



















