ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের হাজারো শিক্ষার্থী আজ সোমবার সকাল থেকে রেলপথ অবরোধের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিল। ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, সরকারের উদাসীনতা ও অবহেলার বিরুদ্ধে তাদের এই কর্মসূচি একটি স্পষ্ট বার্তা। তবে রেল চলাচলে বিশৃঙ্খলা এড়াতে এবং আলোচনার সুযোগ দিতে তারা এই কর্মসূচি সকাল ১১টা পর্যন্ত শিথিল রেখেছেন।
এই বিষয়ে কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের প্রধান প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী বলেন, “সকাল ১১টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক রয়েছে। যদি এই বৈঠকে আমাদের যৌক্তিক দাবিসমূহ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তাহলে আমরা আন্দোলন থেকে সরে আসতে পারি। অন্যথায়, দেশজুড়ে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।”
আন্দোলনের পেছনের প্রেক্ষাপট:
গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই রেলপথ অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেন জুবায়ের। তিনি বলেন, “যদি একটি সাধারণ প্রিন্সিপালের বদলি করতে সরকারের একদিন লাগে, তাহলে তারা আমাদের ছয় দফা যৌক্তিক দাবি কীভাবে পূরণ করবে? সরকার আমাদের অবদানকে যদি অস্বীকার করে, আমাদের ভূমিকাকে তুচ্ছ করে দেখে, তাহলে উন্নয়ন কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”
জুবায়েরের বক্তব্যে উঠে আসে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ। তিনি বলেন, “আমরা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুধুই অধিকার চাইছি না, বরং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলছি। যদি কারিগরি শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দেওয়া না হয়, তাহলে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্নও ফাঁকা বুলি হয়ে যাবে।”
পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি কী কী?
১. ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের অবৈধ পদোন্নতি বাতিল:
হাইকোর্টের রায় বাতিল করতে হবে এবং বিতর্কিতভাবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করতে হবে। ২০২১ সালে রাতের অন্ধকারে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে হবে।
-
ডিপ্লোমা কোর্সে মানোন্নয়ন ও ইংরেজি মাধ্যমে কারিকুলাম:
যেকোনো বয়সে ভর্তি বাতিল করে উন্নত বিশ্বের মতো চার বছর মেয়াদি কোর্স চালু করতে হবে এবং ধাপে ধাপে তা ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। -
ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত পদে অনিয়ম বন্ধ:
উপ-সহকারী প্রকৌশলীর পদে অন্যদের নিয়োগ না দিয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের জন্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে এবং নিয়োগে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। -
কারিগরি প্রতিষ্ঠানে অদক্ষ জনবল নিয়োগ নিষিদ্ধ:
সংশ্লিষ্ট পদগুলোতে কারিগরি ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া নিয়োগ দেওয়া যাবে না। শূন্যপদে দক্ষ শিক্ষক, ল্যাব সহকারী নিয়োগ দিতে হবে। -
স্বতন্ত্র কারিগরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা:
কারিগরি শিক্ষাকে মর্যাদা দিতে এবং বৈষম্য দূর করতে ‘কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠনসহ আলাদা মন্ত্রণালয় করতে হবে। -
উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ:
একটি আধুনিক ‘টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং নড়াইল, নওগাঁ, খাগড়াছড়ি ও ঠাকুরগাঁওয়ে নির্মাণাধীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের শতভাগ ভর্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
কী বলছেন শিক্ষার্থীরা?
শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, তারা দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু তাদের দাবির বিষয়ে কার্যকর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা দেশের উন্নয়নের কথা বলি, স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, অথচ প্রযুক্তি শিক্ষাকে এখনও অবহেলা করা হয়।”
আরেকজন জানান, “সরকার আমাদের কথা না শুনলে, আমরা আরও কঠোর আন্দোলনে যাব। তখন সরকারকে দায় নিতে হবে।”
সিদ্ধান্তের সময় সকাল ১১টা
সবার নজর এখন সকাল ১১টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকের দিকে। আলোচনায় যৌক্তিক সমাধান এলে এই রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার হতে পারে। তবে যদি তা না হয়, তাহলে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নিতে পারে।
পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন শুধু চাকরির দাবি নয়, এটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের সংস্কারের দাবি হিসেবে সামনে এসেছে। সরকার যদি সময়মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ না নেয়, তবে এ আন্দোলন অচিরেই জাতীয় ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে।