অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় শান্তি ফিরেনি—বরং পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এখন চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এমনটাই জানাল বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।
রাজধানীর ধানমণ্ডির ওমেন ভলেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউভিএ) মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় উঠে এলো এক ভয়াবহ চিত্র।
শীর্ষক আলোচনা সভার বিষয় ছিল—‘সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে করণীয়’।
সভায় সভাপতিত্ব করেন আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ, আর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক ও অধিকারকর্মী সতেজ চাকমা।
সতেজ চাকমা বলেন, ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জনগোষ্ঠীর পেশকৃত দাবিনামা তখনকার সরকার অগ্রাহ্য করে। শেখ মুজিবুর রহমান তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলধারার বাঙালি জনগোষ্ঠী বসিয়ে জুম্মদের ওপর আধিপত্যের হুমকি তৈরি করেন।
এই ঘটনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক রূপ বদলে যেতে থাকে—যা স্বাধীন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মূলনীতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
আলোচনা সভায় জানানো হয়,
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগপর্যন্ত অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন মানুষ নিহত, আহত বা নিখোঁজ হন।
এর মধ্যে নিহতদের মধ্যে রয়েছে:
-
পাহাড়ি: ১,১৩৮ জন
-
বাঙালি: ১,৪৪৬ জন
-
সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: ৩৮০ জন
চুক্তি স্বাক্ষরের পরও থেমে থাকেনি সহিংসতা। এ সময়ও আরও ১,৩১৫ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে:
-
পাহাড়ি: ৮৯৯ জন
-
বাঙালি: ৩৯০ জন
-
সেনা বাহিনী: ২৬ জন
আহত হয়েছেন: ১,৮২৩ জন
অপহৃত: ২,১৯৮ জন
কিন্তু এই ঘটনাগুলোর কোনওটাই দৃষ্টান্তমূলক বিচার পায়নি—এটাই সবচেয়ে বড় ব্যর্থত
সভায় জনসংহতি সমিতির তথ্যমতে—পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে।
এর বাইরে ২৯টি ধারা এখনো সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত এবং ১৮টি ধারা আংশিকভাবে বাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে।
সভায় ছয় দফা সুপারিশের মাধ্যমে বলা হয়:
-
বাঙালি সেটলারদের পার্বত্য এলাকা থেকে সম্মানজনক পুনর্বাসন করতে হবে।
-
চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেন—-পাহাড়ি মানুষ কারো সঙ্গে ঝগড়ায় যেতে চায় না। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব মেনে চলি—তবে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই।
তিনি স্পষ্টভাবে বলেন—বিগত সরকারগুলো পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, বর্তমান সরকারেরও নেই কোনও দৃশ্যমান উদ্যোগ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,-আদিবাসী নেই’—এই প্রচারটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আদিবাসী স্বীকৃতি না দিলে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হয় না। তাই এই বিষয়ে গবেষণা ও স্পষ্টতা আনা জরুরি।’
সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন,-এই অস্থিরতা জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটাতে পারে। সামরিক দখল আরও বাড়বে, এবং পাহাড় এক ভয়ঙ্কর সংকটে পড়বে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট সামরিক নয়—এটি রাজনৈতিক সংকট।
আর রাজনৈতিক সমাধানই এর একমাত্র উপায়।
সভায় আরো বক্তব্য দেন,
-
অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী — পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী
-
শামসুল হুদা — এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক
-
সঞ্জীব দ্রং — আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক
পার্বত্য চুক্তি শুধু একটি কাগুজে চুক্তি নয়, এটি পাহাড়ের মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি।
এই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া পাহাড়ে শান্তি ফিরবে না।
মানবাধিকার, নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক স্বীকৃতি—এই তিনটি বিষয়ই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
সরকারের উচিত অবিলম্বে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে চুক্তির প্রতিটি ধারা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
অন্যথায় ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে’—এই আওয়াজ এক সময় আর শুধুই আওয়াজ থাকবে না, রূপ নিতে পারে ভয়ানক উত্তেজনায়।