ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নাম দিয়ে পাকিস্তান ও আজাদ কাশ্মীরের নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। এই ঘটনার রেশে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যে সামরিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে পুরো বিশ্ব। অনেকেই এটিকে "নতুন যুদ্ধের ঘণ্টা" হিসেবে উল্লেখ করছেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি
বুধবার ভোরের আগেই পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে—জইশ-ই-মোহাম্মদ ও লস্কর-ই-তৈয়বার মতো নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনের ঘাঁটি লক্ষ্য করেই এই হামলা চালানো হয়।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “কাশ্মীরে নিরীহ মানুষের রক্ত যারা ঝরিয়েছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতেই ছিল আমাদের এ অভিযান। হামলা হয়েছে সম্পূর্ণ সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে, এবং এতে কোনো বেসামরিক বা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু ছিল না।”
পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
অন্যদিকে পাকিস্তান দাবি করেছে, ভারতের এই ‘আক্রমণাত্মক ও কাপুরুষোচিত’ হামলায় ৮ জন নিহত হয়েছেন এবং তারা প্রতিক্রিয়ায় ভারতের ৫টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (NSC) জরুরি বৈঠক ডেকে বলেছেন, “আমরা এ আগ্রাসনের উপযুক্ত জবাব দেব। আত্মরক্ষায় আমরা প্রস্তুত।”
বিশ্বনেতাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এক বিবৃতিতে তার মুখপাত্র বলেন, “নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের সামরিক অভিযান নিয়ে মহাসচিব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। উভয় দেশকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে হবে, কারণ এই অঞ্চলের সামরিক সংঘাতের ভার বিশ্ব বহন করতে পারবে না।”
ট্রাম্প বললেন, ‘লজ্জাজনক’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “ভারত ও পাকিস্তান এক শতকেরও বেশি সময় ধরে সংঘাতে লিপ্ত। এই ধরনের সংঘাত অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং দ্রুতই এর অবসান হওয়া উচিত।” ট্রাম্প আরও বলেন, “আমরা ঠিক ওভাল অফিসে ঢোকার সময়ই খবরটা পেলাম। এটা একটা ভয়ংকর বার্তা।”
মার্কিন নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিও সরাসরি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের কাছ থেকে ভারতের পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। ফলে মার্কিন প্রশাসন পুরো পরিস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে।
চীনের উদ্বেগ ও আহ্বান
চীন এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, “উত্তেজনা না বাড়িয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে সংযত থাকতে হবে। আমরা শান্তি ও স্থিতিশীলতা কামনা করি।” বেইজিংয়ের এক মুখপাত্র আরও বলেন, “পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে এমন যেকোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে।”
ইরানের কূটনৈতিক প্রয়াস
মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ ইরান আবারও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ভারত সফরে যাচ্ছেন এবং ইতিমধ্যেই ইসলামাবাদ সফর করেছেন তিনি। শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতেই এই সফর বলে জানানো হয়েছে।
ইসরায়েলের সমর্থন
ভারতের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’কে সমর্থন জানিয়েছে ইসরায়েল। ভারতে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত রুবেন আজার বলেছেন, “সন্ত্রাসীদের বুঝে নিতে হবে, নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ করে তারা পালাতে পারবে না।”
🇦🇪 সংযুক্ত আরব আমিরাতের আহ্বান
সংযুক্ত আরব আমিরাত দুই দেশকেই শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে এগোনোর আহ্বান জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র বিষয়ক উপপ্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “সংঘাত নয়, কূটনীতি ও সংলাপই সংকট সমাধানের পথ।”
পরিণতি কতটা ভয়ানক?
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে এমন উত্তেজনা কেবল দক্ষিণ এশিয়াই নয়, পুরো বিশ্বকে অস্থিতিশীল করতে পারে। এই ঘটনার পর বিশ্ববাজারে তেল ও স্বর্ণের দামে অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
'অপারেশন সিঁদুর' হয়তো তাৎক্ষণিক প্রতিশোধের বার্তা দিয়েছে ভারত থেকে, কিন্তু এর প্রভাব কত গভীরে গিয়ে পৌঁছাবে তা সময়ই বলে দেবে। একটি ভুল সিদ্ধান্ত এই দুই দেশের কেবল সীমান্ত নয়, গোটা পৃথিবীকেই অস্থির করে তুলতে পারে।



















