বর্তমান সময়ের অন্যতম ভয়াবহ সামাজিক সংকট হয়ে উঠেছে ‘মব জাস্টিস’। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিনই ঘটছে গণপিটুনি, লুটপাট এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো ঘটনা। অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায় সংঘবদ্ধ কিছু মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার এই প্রবণতাকে বলা হয় ‘মব জাস্টিস’। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে, যা পুরো সমাজব্যবস্থার স্থিতিশীলতায় হুমকি সৃষ্টি করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর মব জাস্টিসের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকায় এবং প্রশাসনের উদাসীনতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে। রাজধানী থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতিবিদ, পুলিশ সদস্য, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে চোর, ডাকাত ও সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কেউই মব জাস্টিসের ভয়াল ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
সাম্প্রতিক উদ্বেগজনক ঘটনা
গত মঙ্গলবার গুলশানের একটি বাসায় ‘মব জাস্টিস’-এর নামে দরজা ভেঙে ঢুকে তল্লাশির নামে তছনছ, লুটপাট এবং ভাঙচুর চালানোর ঘটনা ঘটে। প্রথমে বলা হয়, বাড়িটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ছেলে তানভীর ইমামের। পরে জানা যায়, বাড়িটি তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর, যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। এই ঘটনায় পরে তিনজনকে আটক করা হলেও ঘটনাটি দেশের মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।
একইদিন দুপুরে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় দুই ইরানি নাগরিক মোহাম্মদ আহমদ ও তার নাতি মোহাম্মদ মেহেদীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। মুদ্রা বিনিময়ের সময় তর্কে জড়িয়ে গেলে তাদের ছিনতাইকারী বলে সন্দেহ করে মব সৃষ্টি হয় এবং মারধর করা হয়। পরে পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব জাস্টিসের প্রবণতা সমাজের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। তারা বলছেন, বিগত সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে জনমানসে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, বর্তমানে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এই ধরনের সহিংস ঘটনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা সামাজিক বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত বহন করে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এটি আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।’
সরকারের অবস্থান
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র বক্তব্য দিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এলাকাভিত্তিক টহল বাড়ানো এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে পারে।
পরিণতি
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই প্রবণতা শুধু অপরাধীদের শাস্তি দিতে গিয়েই থেমে থাকছে না, বরং নিরপরাধ মানুষকেও শিকার বানাচ্ছে। সাতকানিয়ার ঘটনায় দুই ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হন, যাদের জামায়াতে ইসলামী তাদের কর্মী বলে দাবি করেছে।
সমাধান কি?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনার লাগাম টানতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করা এবং দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন মব জাস্টিস’-এর মতো ভয়াবহ প্রবণতা রুখতে প্রশাসনের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রমাণসহ যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করতে হবে। অন্যথায় এই অস্থিরতা সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে চরমভাবে ব্যাহত করবে।



















