মাহফুজ জাহিদ:
নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলায় মানুষ যেন প্রতিদিন মৃত্যুর মুখে হেঁটে চলছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব, ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি, দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়ক এবং পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে এবার গণদাবি নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে স্থানীয় নাগরিক সংগঠন ‘আমরা বন্দরবাসী’। সংগঠনের পক্ষে নেতৃত্ব দেন এ আই আকাশ। স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম।
প্রায় চার লাখ মানুষের বাস নারায়ণগঞ্জের এই বন্দর উপজেলায়। কিন্তু প্রতিনিয়ত এই মানুষগুলো শিল্প কারখানার দুষিত বাতাস, পানিবাহিত রোগ এবং অনিরাপদ রাস্তায় জীবন হুমকির মুখে ফেলে বেঁচে আছে। স্মারকলিপিতে এসব সমস্যার সমাধানের জন্য সাত দিনের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে।
বন্দর এলাকার অন্যতম প্রধান দূষণের উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আকিজ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। উন্মুক্তভাবে লিমস্টোন আনলোড করার ফলে আশপাশের ২২, ২৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডসহ আশেপাশের এলাকাজুড়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে ধুলার ঝড়। এতে শ্বাসকষ্ট, চোখে জ্বালা ও নানা চর্মরোগে ভুগছেন এলাকাবাসী।
এই একই শিল্প এলাকায় গড়ে উঠেছে আটা-ময়দার মিল এবং ফিডমিল—যেখান থেকে দুর্গন্ধযুক্ত নির্গত বর্জ্য মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। বিশেষ করে মদনপুর-মদনগঞ্জ মহাসড়কের বাগবাড়ি এলাকায় স্থাপিত আকিজ এগ্রো ফিডমিল থেকে নির্গত গন্ধ এবং বর্জ্য পানিতে মিশে নানারকম রোগ ছড়াচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন যদিও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে, তবে বাস্তবে চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বন্দরের নতুন ৯টি ওয়ার্ডে পানির অভাব সবচেয়ে ভয়াবহ। হাতে গোনা কয়েকটি গভীর নলকূপ থাকলেও, সেগুলো বেশিরভাগ সময় বিকল। ফলে দুই লাখের বেশি মানুষ বছরের পর বছর বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে কষ্টে দিন পার করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, যেটুকু পানি সরবরাহ করা হয়, তাও প্রায়শই বিশুদ্ধ নয়। ফলে পানিবাহিত টাইফয়েড, আমাশয় ও পেটের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অসংখ্য নারী-শিশু। এলাকাবাসীর দাবি, সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যেন দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেন নলকূপ মেরামত ও নতুন পানির লাইন স্থাপনের জন্য।
বন্দরের প্রধান সড়ক মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক যেন এক মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। খানাখন্দে ভরা রাস্তাগুলোতে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। বিকল হয়ে পড়ে থাকা যানবাহন, যানজট এবং ধূলাবালিতে অসহ্য পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নবীগঞ্জ ঘাট থেকে কাইকারটেক লিংক রোড এবং বন্দর ঘাট থেকে ঘারমোরা পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা আরও শোচনীয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, জনপ্রতিনিধিরা এই রাস্তাগুলোর উন্নয়নের জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেননি। ফলে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, নারী ও বৃদ্ধ সবাই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এই সড়কগুলো দ্রুত সংস্কারের দাবি জানিয়েছে ‘আমরা বন্দরবাসী’।
গ্যাস সংযোগ নিয়েও রয়েছে ভয়াবহ দুর্নীতি ও দালালি চক্রের দৌরাত্ম্য। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিছু দুর্বৃত্ত সাধারণ মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আদায় করে দিচ্ছে অবৈধ সংযোগ। আবার মাঝে মাঝে ভয় দেখিয়ে গ্যাস লাইন কেটে জরিমানা আদায় করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, অবিলম্বে অবৈধ সংযোগ বন্ধ করে বৈধ সংযোগ নিশ্চিতে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন।
‘আমরা বন্দরবাসী’র পক্ষ থেকে স্মারকলিপিতে সাত দিনের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আগামী সাত দিনের মধ্যে আকিজ ফ্যাক্টরির মালিকপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে যাবে জনগণ।
তারা বলেন, “আমরা বন্দরে জন্ম নিয়ে ভুল করিনি। গুলশান-বনানীর মতোই খাজনা, ট্যাক্স সব দেই; অথচ পাচ্ছি না ন্যূনতম মৌলিক সুযোগ। আমাদের দাবিগুলো যদি না মানা হয়, তবে এ জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন – সেটাই শ্রেয়।”
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। বন্দরবাসীর দাবি, তিনি যেন বাস্তবসম্মত, দ্রুত এবং মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের ব্যবস্থা করেন।