ফেসবুকে মহানবী (স.)-কে ‘অবমাননা’: উত্তাল বাকেরগঞ্জ, ভুয়া আইডির অভিযোগেও কারাগারে যুবক
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা রীতিমতো উত্তপ্ত। শুক্রবার বিকেল থেকে শুরু হওয়া উত্তেজনা গিয়ে ঠেকে শনিবার ভোরে এক ভয়াবহ রূপে—যেখানে থানার চারপাশ ঘিরে জনতার বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, মাইকিং করে আন্দোলনের ডাক এবং সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গর্জে ওঠা মানুষের ঢল।
ঘটনার শুরু শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৩টা নাগাদ। হঠাৎই একটি ফেসবুক পোস্টে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়। এতে কলসকাঠী ইউনিয়নের সাধারণ জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। অভিযোগ ওঠে, ফেসবুকে সৌরভ দত্ত নামের এক যুবকের আইডি থেকে ওই পোস্টটি দেওয়া হয়েছে।
সৌরভ দত্ত (২৪) বেবাজ গ্রামের বাসিন্দা এবং বাবুল দত্তের ছেলে। বিষয়টি জানাজানি হতেই তিনি নিজেই থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তার দাবি, ওই ফেসবুক আইডিটি তার নয়। বরং কেউ তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে একটি ভুয়া প্রোফাইল খুলে ওই পোস্ট দিয়েছে। থানায় জিডি করেও রক্ষা পাননি সৌরভ।
তৌহিদি জনতার ক্ষোভে কাঁপে থানা চত্বর
বিকালে যখন ঘটনাটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন স্থানীয় আলেম-ওলামারা এটিকে ধর্মীয় অবমাননা হিসেবে নেন। রাত ১১টার দিকে অসংখ্য মানুষ বাকেরগঞ্জ থানা ঘেরাও করে। তাদের দাবি ছিল—যাকে পোস্টের জন্য দায়ী করা হচ্ছে, তাকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।
বিপুল জনতার চাপে পুলিশ সৌরভকে থানায় নিয়ে আসে। পরে জনতার উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ তাকে বরিশাল ডিবি অফিসে স্থানান্তর করে। কিন্তু এই পদক্ষেপ জনতাকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে।
মাইকিং করে মানববন্ধনের ডাক, সড়ক অবরোধ
শনিবার ভোরে কলসকাঠীর মসজিদগুলো থেকে মাইকিং করে সৌরভের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মানববন্ধনের আহ্বান জানানো হয়। ফজরের নামাজের পর থেকে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সড়কে অবরোধ, থানার সামনে বিক্ষোভ এবং স্থানীয় প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে।
তারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়—ওসি আবুল কালাম আজাদ ও এসআই তোফাজ্জেলকে সরাতে হবে এবং সৌরভকে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে, না হলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবে।
ভুয়া আইডি না আসল পোস্ট? বিভ্রান্তির ভেতরেও মামলা
কলসকাঠীর বাসিন্দা কাওসার হোসেন বাদী হয়ে সৌরভের বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম আইনে মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, তিনি ফেসবুকে মহানবী (স.) সম্পর্কে অবমাননাকর পোস্ট দেখতে পান। এ বিষয়ে থানার ওসি জানান, সৌরভের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে এবং রাতেই তাকে আদালতে পাঠানো হয়।
অন্যদিকে সৌরভের পরিবারের দাবি, এই মামলার পেছনে রয়েছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। তার বাবা বাবুল দত্ত বলেন, “ঝড়ের কারণে গত দুই দিন ধরে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন ছিল। আমাদের কেউ ফেসবুকে সক্রিয় ছিল না। মসজিদের ইমাম মিজানুর রহমান এসে আমাদের জানালে আমরা ব্যাপারটি বুঝি। এরপর আমার ছেলে থানায় গিয়ে নিজেই জিডি করে।”
মিজানুর রহমান, যিনি নিজে জামায়াতের স্থানীয় শাখার সভাপতি এবং মসজিদের ইমাম, জানান—“আমি নিজেই সৌরভের সঙ্গে কথা বলার সময় দেখি একই আইডি থেকে আরেকটি পোস্ট হয়। তখনই আমি বুঝে যাই, এটি তার নিজের আইডি নয়। কেউ তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”
জনতার দাবি: সঠিক তদন্ত ও প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি
জনতা যেমন সৌরভের শাস্তি চায়, তেমনি তার পরিবার ও এলাকার সচেতন নাগরিকরা ঘটনার পূর্ণ তদন্ত দাবি করেছেন। তারা চান প্রকৃত দোষী শনাক্ত হোক এবং কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হয়।
আন্দোলনকারীরা বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছি। তবে পুলিশের দায়িত্বহীনতা ও দেরিতে পদক্ষেপ নেওয়াই পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হতো, তাহলে এমন হতো না।”
শেষ কথা
বাকেরগঞ্জের ঘটনাটি আরও একবার মনে করিয়ে দেয়—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া আইডির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলা কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয়, সৌরভ সত্যিই নির্দোষ, তবে সেটি যেমন আইন ও বিচার ব্যবস্থার জন্য বড় পরীক্ষা হবে, তেমনি সমাজের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।