লোহিত সাগরে মার্কিন পিছু হটা: হুথি হামলার মুখে ইসরায়েল নিঃসঙ্গ
মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনা যখন চরমে, তখন হুথি যোদ্ধাদের হামলায় রীতিমতো কোণঠাসা মার্কিন নৌবাহিনী। ইয়েমেন থেকে উৎক্ষেপিত ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র একের পর এক আঘাত হানছে রেড সি বা লোহিত সাগরে মোতায়েন মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও বিমানবাহিনীর ওপর। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার এই হামলা লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়ে সরাসরি ক্ষতিসাধন করেছে, যা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে আন্তর্জাতিক মহলে।
বিশেষ করে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারিয়েস ট্রুম্যান একাধিকবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একাধিক যুদ্ধবিমানও। এমনকি ১৩ই মে একটি মার্কিন যুদ্ধবিমান সাগরে ডুবে যায়, যার ব্যাখ্যায় ওয়াশিংটন বলছে এটি “যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মহড়ার সময় দুর্ঘটনা”। কিন্তু একই ধরনের ঘটনা এক সপ্তাহ আগেও ঘটায় ব্যাখ্যাটি নিয়ে ব্যাপক সংশয় তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র-হুথি গোপন চুক্তি: পিছু হটার নির্দেশ!
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন করে চমক সৃষ্টি করেছে ইউএসএস ট্রুম্যানের হঠাৎ রেড সি ত্যাগের খবর। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ‘প্রেস টিভি’ জানিয়েছে, মার্কিন সরকার ও হুথি নেতৃত্বের মধ্যে ওমানের মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তির আওতায় হুথিরা যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে আর কোনো সামরিক হামলা চালাবে না।
এই চুক্তির অংশ হিসেবে ইউএসএস হ্যারিয়েস ট্রুম্যানকে অবিলম্বে রেড সি থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থাৎ, মার্কিন রণতরী সরিয়ে নেওয়ার ফলে এ অঞ্চলে আর কোনো মার্কিন সামরিক উপস্থিতি থাকবে না। হুথিদের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র এবার কূটনৈতিক পথেই নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চাইছে।
ইসরাইলের জন্য দুঃসংবাদ: মার্কিন সহায়তা নেই
এই কূটনৈতিক চুক্তির সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইসরাইল। কারণ রেড সিতে মার্কিন রণতরীর উপস্থিতি এতদিন হুথিদের ছোড়া মিসাইল ভূপাতিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। এখন ট্রুম্যান সরিয়ে নেওয়ার ফলে, হুথি ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে কার্যত একা পড়ে গেছে ইসরাইল।
সর্বশেষ ১৭ই মে, মধ্য ইসরাইলে হুথিদের ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলার ঘটনা তারই প্রমাণ। হামলার সময় ইসরাইলজুড়ে সতর্কতা সাইরেন বেজে ওঠে, আতঙ্কে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে ছুটে যায় শত শত মানুষ। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দাবি অনুযায়ী, তারা মিসাইলটি ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে এবং হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে এটি স্পষ্ট যে হুথিদের হামলার ধরন ও পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
নেতানিয়াহু একা, যুক্তরাষ্ট্র ‘কৌশলী’ চুক্তিতে ব্যস্ত
বর্তমান বাস্তবতায়, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এখন কার্যত একাই হুথিদের ক্রমাগত হামলার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যাকে ইসরাইল সবসময় সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে দেখেছে, সেই দেশটি এবার কূটনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে নিজেদের নিরাপদ করেছে। এই পরিস্থিতিকে ইসরাইলের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকেই ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখছে।
এদিকে এই চুক্তির মাধ্যমে হুথিরা যেমন নিজেদের সামরিক শক্তির স্বীকৃতি পেল, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে সরাসরি লড়াই না করে, শান্তি আলোচনার মাধ্যমে পথ খোঁজার বার্তা দিল। তবে এই শান্তির মাশুল দিতে হচ্ছে ইসরাইলকে, যারা এখন মধ্যপ্রাচ্যে একা দাঁড়িয়ে একটি শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটা এবং হুথিদের সঙ্গে গোপন সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এক নতুন মোড় এনে দিয়েছে। ইসরাইলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষের ইঙ্গিতও দিতে পারে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায় — হুথিদের মতো একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী যখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রকে পিছু হটাতে বাধ্য করে, তখন সেই অঞ্চল কতটা অস্থিতিশীল, সেটিই বা কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে সবাইকে।