close

ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!

লিচুর বাগানে’ যে কারণে ‘পিরিতের বেড়া’ দিতে হয়

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
‘তাণ্ডব’ সিনেমার ‘লিচুর বাগানে’ গানটি এখন পুরো দেশের মুখে মুখে। কিন্তু এই গানটি কেবল বিনোদন নয়, লুকিয়ে আছে এক ঘেটু ঐতিহ্য, প্রেমের রূপক আর সাংস্কৃতিক আবেগের গভীর তাৎপর্য। জানতে চান কেন “লিচুর বাগানে প..

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে একটি গান ঝড় তুলেছে—‘লিচুর বাগানে’। তাহসান অভিনীত ‘তাণ্ডব’ চলচ্চিত্রের এই গানটি কেবল একটি মিউজিক ভিডিও নয়, বরং পরিণত হয়েছে এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আলোচনায়। বাসে, কফিশপে, স্টোরিতে, রিলসে—যেদিকেই তাকানো হোক, এই গানটির সুর যেন বাতাসে ভাসছে।

চরকি ও এসভিএফ প্রযোজিত এই গানটি ইউটিউবে একসাথে ১৫ মিলিয়নের বেশি বার দেখা হয়েছে। এত বড় সাড়া জাগানো গানের পেছনে কেবল সুন্দর লোকেশন, নান্দনিক কোরিওগ্রাফি বা সুর নয়—আছে এক ঐতিহ্যবাহী গানের শেকড়, লোকসংস্কৃতির রসায়ন, প্রেম ও প্রতীকের গভীর রূপক।

 

গানের একটি পঙ্‌ক্তি যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে শ্রোতাদের মধ্যে: “কে দিল পিরিতের বেড়া, লিচুর বাগানে?” এই একটি লাইন ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে আলোড়ন। বন্ধুরা একে অপরকে মেনশন করে হাস্যরসের প্রশ্ন ছুঁড়ছে: “তুই বেড়া ডিঙাতে পারলি?” কিন্তু এই লাইনের ভেতরেই রয়েছে ঘেটু গানের অতীত, সংস্কৃতি এবং একটি প্রেমের ব্যঞ্জনা।

 

গানটির মূল রচয়িতা হিসেবে যাঁর নাম উঠে আসে তিনি ছত্তার পাগলা—নেত্রকোনার এক লোকসংগীত স্রষ্টা, যিনি জীবনভর ঘেটু গান রচনা ও পরিবেশনায় নিযুক্ত ছিলেন। সংগীতগবেষক সরোজ মোস্তফা তাঁর নাম উচ্চারণ করলেও, গৌতম কে শুভর মতে এটি মূলত একটি প্রচলিত ঘেটু গান—যার সঙ্গে ছত্তার পাগলা তাঁর নিজস্ব কথাগুলো জুড়ে দিয়েছেন।

ছত্তার পাগলা প্রয়াত হন ২০১৪ সালে। তিনি জীবদ্দশায় শত শত গান রচনা করেছিলেন। ‘লিচুর বাগানে’র মতো আরও অনেক গান স্থান পেয়েছে বাংলার লোকজ আকাশে।

 

ঘেটু গান সাধারণত ছিল সুর ও নৃত্যের মিশেল। কিশোর ছেলেদের মেয়ে সাজিয়ে গান ও নাচ পরিবেশন করা হতো। সেখানে মূর্ত হত একধরনের গ্রামীণ নাটকীয়তা, রস, এবং রূপকল্প।

যেমন ঘেটু গানের কিছু উদাহরণ

      তুই আমারে চিনলে নারে, আমি তো রসের কমলা
      ঘুমাইলারে বন্ধু, এক বালিশে দুইটি মাথা

এই গানের লাইনগুলোতে যেমন সরলতা আছে, তেমনি আছে তীব্র আবেগ, যা সহজেই শ্রোতার হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।

 

এখানে ‘বেড়া’ মানে বাধা, আর ‘পিরিতের বেড়া’ মানে প্রেমে বাধা। কিন্তু ‘লিচুর বাগানে’ কেন এই প্রেমের বেড়া? সরলভাবে বলা যায়, গানের রচয়িতা আশপাশের পরিবেশ থেকে উপমা খুঁজেছেন। ‘লিচু’ এখানে হয়ে উঠেছে আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, আর বাগান হয়েছে ভালোবাসার ক্ষেত্র। আর বেড়া? তা ভালোবাসাকে আগলে রাখার প্রতীকী প্রতিবন্ধকতা।

গানে পাখিকে বলা হচ্ছে লিচু না খেতে, কারণ সেটি প্রিয়জনের জন্য তোলা। কিন্তু পাখির আকর্ষণ তো স্বাভাবিক, তাই তাকে ঠেকাতে বেড়া দিতে হয়—ঠিক যেমন ভালোবাসাকেও আগলে রাখতে হয়।

 

এ গানের সারমর্ম বোঝায়—ভালোবাসায় জিততে হলে আগলে রাখতে হয়, লড়াই করতে হয়। প্রেম মানে কেবল পাওয়া নয়, বরং তা ধরে রাখার সংগ্রামও। বেড়া তাই এখানে নিষেধ নয়, বরং নিরাপত্তার প্রতীক।

‘লিচুর বাগানে পিরিতের বেড়া’ তাই হয়ে উঠেছে একটি সাংস্কৃতিক রূপক। যেমন মানুষ নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যের আগ্রহ থেকে রক্ষা করতে চায়, তেমনি গানেও এসেছে প্রেম রক্ষার গভীর মানসিকতা।

 

‘লিচুর বাগানে’ গানটি আজ ভাইরাল—কিন্তু এটি কেবল ভাইরাল বিনোদন নয়। এটি আমাদের লোকজ ঐতিহ্য, ঘেটু সংস্কৃতি, প্রেমের রূপক, সামাজিক বাস্তবতা এবং এক অনন্য সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ।

এই গানটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ভালোবাসা কেবল অনুভব নয়, একে রক্ষা করার দায়িত্বও বয়ে বেড়াতে হয়। আর তাই, লিচুর বাগানে পিরিতের বেড়া দিতেই হয়।

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি


News Card Generator