করোনা যেন হারিয়ে যায়নি, বরং অপেক্ষায় ছিল আরেকটি ঢেউয়ের। সেই আশঙ্কাই এবার বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। ফের নতুন রূপে ফিরে এসেছে মহামারি করোনা ভাইরাস, আর ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে সংক্রমণ। জুন মাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ জনে, যা গোটা দেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য এক নতুন সংকেত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন করোনার আরেকটি ঢেউয়ের মুখে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মতোই এদেশেও সংক্রমণের হার দ্রুত বেড়ে চলেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর এই ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) পরিচালিত কোভিড-১৯ সার্ভিলেন্স ‘ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্স ও পিএইচওসি’ বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ভয়ংকর এক চিত্র। চলতি বছরের মে মাস থেকে দেশের করোনা সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করেছে।
জুন মাসে ১,৪০৯টি নমুনা পরীক্ষায় ১৩৪ জনের শরীরে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে, যা মোট পরীক্ষার ৯.৫১ শতাংশ—এই হার ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত সময়ে সর্বোচ্চ। তুলনামূলকভাবে এর আগের বছরগুলোতে সংক্রমণের হার ছিল মাত্র ১.৫ শতাংশের একটু বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন করে শনাক্ত হওয়া ভাইরাসের ধরনটি পূর্বের চেয়েও বেশি সংক্রামক। সর্বশেষ পাওয়া নমুনাগুলোর জিনোম সিকুয়েন্সিংয়ে ‘ওমিক্রন বিএ.২.৮৬’ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, যা দেশের ভেতর আগে শনাক্ত হলেও এবার আরও শক্তিশালী রূপে ফিরে এসেছে। আইসিডিডিআরবি বলছে, নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট ‘এক্সএফজি’ এবং ‘এক্সএফসি’-ই মূলত সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে দায়ী।
জুন মাসের প্রথম ১০ দিনে করা ১৪টি জিনোম সিকুয়েন্সিংয়ের ১২টিতেই পাওয়া গেছে এক্সএফজি ভ্যারিয়েন্ট, যা ওমিক্রনের জেএন.১ উপশাখা। সাম্প্রতিক নমুনাগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই এই ভয়ংকর ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে।
সোমবার (৩০ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ২১ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি। ২০২৫ সালে এ পর্যন্ত দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬৯ জনে। আর সবমিলিয়ে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ২০ লাখ ৫২ হাজার ১১৪ জনে।
গত ২৪ ঘণ্টায় কেউ মারা না গেলেও ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত করোনায় মোট ২২ জন মারা গেছেন, এবং সকলেই মারা গেছেন জুন মাসে। এই পরিসংখ্যান বলছে, করোনা আবার ফিরে এসেছে ভয়ংকর রূপে। আর এখনই যদি সাবধান না হওয়া যায়, তবে পরিস্থিতি আবারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী স্পষ্টভাবে বলেন, “বাংলাদেশ এখন করোনার নতুন ঢেউয়ের মুখোমুখি। আমরা এখন যা দেখছি তা বরফখণ্ডের পানির উপরের অংশ মাত্র। প্রকৃত সংক্রমণ অনেক বেশি, যার বড় অংশ ধরা পড়ছে না।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে রিপোর্ট হওয়া মৃত্যুর সংখ্যা শুধু আনুষ্ঠানিক তথ্য। এর বাইরেও করোনায় মৃত্যু ঘটছে বলে আমরা ধারণা করছি।” তার মতে, নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো দ্রুত ছড়ালেও বর্তমানে রোগের তীব্রতা তুলনামূলকভাবে কম, তবে অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে ভাইরাস যেকোনো সময় আগের মতো বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র পথ সচেতনতা। মাস্ক পরা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, নিয়মিত হাত ধোয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো বেশি সংক্রামক, তাই একমাত্র সচেতন জীবনযাপনই পারে এই নতুন ঢেউ ঠেকাতে।
করোনা এখন শুধুই অতীত নয়—বর্তমানের এক বাস্তব হুমকি। নতুন রূপ, নতুন শক্তি, এবং নতুন ঢেউয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। এখনই যদি আমরা সকলে সচেতন না হই, তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। প্রতিরোধের পথ আমাদের হাতেই—সচেতনতা, সতর্কতা, আর স্বাস্থ্যবিধি।



















