ভুল নীতির বোঝা বইছে অর্থনীতি: ভেঙে পড়ছে ব্যাংক খাত, উত্তপ্ত ডলারের বাজার
বাংলাদেশের অর্থনীতি এক ভয়াবহ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে, যার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতি ও দায়িত্বহীন আচরণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু বেফাঁস বক্তব্য ও নীতিগত ত্রুটির কারণে ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, ডলারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি এবং বিনিময় হার নিয়ে একের পর এক পরীক্ষানিরীক্ষা অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করেছে।
গভর্নরের বক্তব্যে আতঙ্ক, ব্যাংকে হুমড়ি খেয়ে আমানত উত্তোলন
২০২২ সালের ৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে।” এই ঘোষণার পরই দেশের ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ সংকটের সূচনা হয়। গ্রাহকদের মধ্যে ভয় এবং অনাস্থা ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলস্বরূপ লাখো মানুষ ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়া শুরু করে। ফলে কয়েকটি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়া হওয়ার মতো অবস্থায় পড়ে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের মন্তব্য কোনোভাবেই দায়িত্বশীল হতে পারে না। ব্যাংক খাতের ভিত্তিই হলো গ্রাহকের আস্থা, আর তা নষ্ট করে দিলে গোটা অর্থনীতির উপরেই পড়ে তার নেতিবাচক প্রভাব।
বারবার টাকা ছাপিয়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না ব্যাংক খাত
ব্যাংকগুলোকে রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার টাকা ছাপিয়েছে, কিন্তু তাতে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। অন্তত ১০টির মতো ব্যাংক এখনো মারাত্মক দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। দফায় দফায় সাহায্য দেওয়ার পরও তারা অর্থনীতির মূল ধারায় ফিরতে পারছে না। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও ক্রমেই ক্ষীণ হচ্ছে।
রিজার্ভ কমেছে ভয়াবহভাবে, ডলার বাজারে অস্থিরতা
২০২২ সালের নভেম্বরে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে, সেখানে সেটি এখন নেমে এসেছে ২৫.৬৪ বিলিয়নে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে হলে রিজার্ভ বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ আমদানি বাড়লেই বাড়ে ডলারের চাহিদা, আর রিজার্ভ দুর্বল হলে তাতে অস্থিরতা ছড়ায় পুরো বাজারে।
ডলারের দাম ৯৬ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১২৩ টাকায় পৌঁছেছে। খোলাবাজারে এই দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫-১২৬ টাকায়। এত দিন বাংলাদেশ ব্যাংক একের পর এক “এক্সপেরিমেন্ট” চালিয়ে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাতে স্থিতিশীলতা না এসে বরং বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠেছে।
আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে দুর্দশা বাড়ছে
আইএমএফের ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পেতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকার বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করেছে। এর ফলে ডলারের দাম বাড়ছে, বাড়ছে আমদানির খরচও। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, আর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও কষ্টকর হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি যেন বাংলাদেশে তৈরি না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।
বিনিয়োগে ভাটা, বেড়েছে সুদহার
নীতিসূদের হার বাড়ানো হয়েছে চার দফায়, ফলে এখন ব্যাংকঋণের সুদহার ১৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, কারণ ঋণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে উঠেছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেমে এসেছে তলানিতে, যা ভবিষ্যতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বড় ধস নামাতে পারে।
“ম্যানেজ ফ্লোটিং” – আসলেই কি কাজ করছে?
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, তারা “ম্যানেজ ফ্লোটিং” পদ্ধতি অনুসরণ করছে, অর্থাৎ বাজারে ঘাটতি হলে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করবে, আর অতিরিক্ত থাকলে বাজার থেকে কিনবে। কিন্তু বাস্তবে ডলারের সরবরাহ সীমিত এবং বাজারে দাম বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কাগজে-কলমে পলিসি থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ খুবই দুর্বল।
রেমিট্যান্সেও আশঙ্কা, হুন্ডির ভয় বাড়ছে
যুক্তরাষ্ট্র রেমিট্যান্সের ওপর ৫% কর বসিয়েছে। এর ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেল বাদ দিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের সুপারিশ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই সময় রিজার্ভ জোরদার করার। বিদেশি ঋণ ও সাহায্যের অর্থ দ্রুত দেশের ভেতরে নিয়ে আসা, হুন্ডি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল ও প্রজ্ঞাবান হতে হবে—তা না হলে দেশের অর্থনীতি সামনে ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে ভুল নীতির প্রয়োগ, দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য, এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি। এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে আগামী দিনগুলো আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এই সংকট শুধু ব্যাংক বা বাজারের নয়—এটি হয়ে উঠছে গোটা দেশের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি।