উল্টো মুখে কাঠগড়ায় নুসরাত ফারিয়া: আদালতে জলভেজা চোখ, মুখে নীরবতা
রাজধানীর ভাটারা থানায় দায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলায় আলোচিত অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়াকে আজ ১৯ মে (সোমবার) কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ ফারজানা হক এই আদেশ দেন। মামলার গুরুত্ব এবং বিতর্কিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে আদালত বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন।
ঘটনার গভীরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিশেষ করে, ঘটনার সময় নুসরাত ফারিয়া বিদেশে ছিলেন কি না, তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে কোনো অবস্থান নিয়েছিলেন কি না, এসব বিষয় স্পষ্ট করার জন্য তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছেন বিচারক। একইসঙ্গে তার জামিন শুনানির জন্য ২২ মে দিন ধার্য করেছেন।
আদালতে নাটকীয় উপস্থিতি: উল্টো মুখে দাঁড়িয়ে নিরব প্রতিবাদ!
সকালে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয় নুসরাত ফারিয়াকে। তাঁকে প্রথমে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। পরে সকাল ৯টা ৫৮ মিনিটে পুলিশ প্রহরায় বের করা হয়। মাথায় হেলমেট, মুখে সাদা মাস্ক ও গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট—এ যেন বাস্তবের চেয়ে সিনেমার দৃশ্য!
উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের নজরে আসে, কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর পর ফারিয়া হঠাৎ উল্টো দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে যান। মুখ থেকে মাস্ক একটু নামিয়ে হাঁপাতে থাকেন। পানি পান করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। তারপরই মুখ ঘুরিয়ে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিচারক এজলাসে উঠলে ১০টা ৫ মিনিটে তিনি ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ান। দুই হাতে কাঠগড়ার রেলিং আঁকড়ে ধরেন যেন একটা অদৃশ্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জামিনের আবেদন: কানাডা সফরের প্রমাণ ও চোখে কান্না
শুনানির সময় তার পক্ষে দাঁড়ানো আইনজীবী মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন বলেন,
“নুসরাত ফারিয়া একজন স্বনামধন্য শিল্পী। তিনি গত বছরের ৯ জুলাই কানাডায় শুটিং করতে যান এবং ১৪ আগস্ট দেশে ফেরেন। আমরা তার সব কাগজপত্র আদালতে দাখিল করেছি। তিনি আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, সরকারের পক্ষ অবলম্বন করেননি। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন।”
এই বক্তব্য চলাকালীন সময়েও ফারিয়া ছিলেন নিস্তব্ধ। কেবল তার চোখদুটো টলমল করছিল। তিনি আদালতের ভেতর একপ্রকার স্থির ভাস্করের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন—চোখে কান্না, ঠোঁটে নীরবতা।
আটকের পেছনের গল্প: থাইল্যান্ডগামী ফ্লাইট থেকে গ্রেপ্তার
এর আগে গতকাল (১৮ মে) দুপুরে থাইল্যান্ডগামী ফ্লাইটে উঠতে গিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। পরে তাকে ভাটারা থানায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এই মামলায় তাকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিরোধী পক্ষের অর্থদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠদের হয়ে কাজ করছিলেন এবং আন্দোলন দমন করতে সহায়তা করেছেন।
মামলার বিস্তৃতি: তারকারাও আসামি, রাজনীতিকরাও
এই আলোচিত মামলায় শুধু নুসরাত ফারিয়াই নন, আসামির তালিকায় আছেন আরও বহু তারকা। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন—
-
অপু বিশ্বাস
-
আসনা হাবিব ভাবনা
-
অভিনেতা জায়েদ খান
-
এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সরকারের সংশ্লিষ্ট ২৮৩ জন, ও অজ্ঞাতনামা তিন থেকে চারশত ব্যক্তি রয়েছেন এই মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায়।
মামলার অভিযোগ অনুসারে, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকারপন্থী অবস্থান নেওয়ার কারণে বিভিন্ন পক্ষ থেকে এসব তারকাদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, ষড়যন্ত্র ও অর্থদানের অভিযোগ আনা হয়।
পরবর্তী অধ্যায়: ২২ মে জামিন শুনানি, তদন্তের অপেক্ষা
আদালত আগামী ২২ মে শুনানির দিন ধার্য করেছে। এর আগে তদন্ত কর্মকর্তা মামলার প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেবেন বলে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। ততদিন পর্যন্ত নুসরাত ফারিয়াকে কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ বহাল থাকবে।
শেষ কথা: চুপচাপ প্রতিরোধের মুখোমুখি এক তারকা
এই ঘটনা যেন শুধু একটি মামলার প্রসঙ্গ নয়—এ এক তারকার নীরব লড়াই, যেখানে ক্যামেরার সামনে উজ্জ্বল মুখ, কাঠগড়ায় এসে হয়ে গেল নীরব প্রতিবাদীর প্রতীক। চোখে জল, মুখে না বলা হাজার কথা—নুসরাত ফারিয়ার এই মুহূর্তটি হয়তো বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও বিনোদন জগতের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।