নেতানিয়াহুর শর্তে গাজায় যুদ্ধবিরতির ইঙ্গিত, চাপে হামাস
গাজা উপত্যকায় চলমান ভয়াবহ যুদ্ধ বন্ধে অবশেষে রাজি হয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু— এমনই এক চমকপ্রদ খবর মিলেছে ইসরায়েলি প্রশাসনের শীর্ষ সূত্র থেকে। তবে এই যুদ্ধবিরতি “শুধু মাত্র” সাদামাটা একটি চুক্তিতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কঠিন ও কৌশলগত শর্ত, যা হামাসের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
নেতানিয়াহু স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, যদি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পথ খোলা রাখতে হয়, তবে প্রথমত হামাসকে গাজা ছাড়তে হবে এবং দ্বিতীয়ত পুরো উপত্যকাকে হতে হবে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ। এমন ঘোষণা এখন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবনায় সম্মতি, তবে কৌশলী অবস্থান
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান আসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকোফের মধ্যস্থতায় আনা একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে। উইটকোফ প্রস্তাব দিয়েছেন, গাজায় ৪৫ দিনের একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হোক। এই সময়ের মধ্যে হামাস ১০ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে এবং পাল্টা হিসেবে ইসরায়েলও নির্দিষ্ট ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেবে।
এই অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়েই একটি স্থায়ী চুক্তির কাঠামো তৈরি করা হবে— এমনই পরিকল্পনা রয়েছে মধ্যস্থতাকারীদের।
স্থায়ী যুদ্ধবিরতির শর্ত: গাজা হবে ‘নিরস্ত্র’, হামাস হবে ‘নির্বাসিত’
তবে শুধু অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি নয়, নেতানিয়াহু এখন স্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও আগ্রহ দেখিয়েছেন, যা তার আগের অবস্থানের সাথে বিপরীত। এর আগে তিনি গাজায় যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
নতুন অবস্থানে তিনি বলেন, যদি স্থায়ী শান্তি চাই, তাহলে হামাসকে গাজার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে ছাড়তে হবে। এমনকি গাজা উপত্যকাকে হতে হবে পুরোপুরি নিরস্ত্র। অর্থাৎ, সেখানে কোনো অস্ত্র, কোনো প্রতিরোধকারী গোষ্ঠী থাকবে না।
এই শর্ত মানতে গেলে হামাসের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আর সেটিই এখন বড় প্রশ্ন— হামাস কি এই কঠিন শর্তে রাজি হবে?
আলোচনায় দোহা, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনিশ্চিত
ইতোমধ্যে ইসরায়েলের আলোচনাকারী দল কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থান করছে এবং যুদ্ধবিরতির চুক্তির সম্ভাব্য সব দিক বিশ্লেষণ করছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এক বিবৃতিতে জানায়, “চূড়ান্ত আলোচনার কাঠামোতে রয়েছে উইটকোফের প্রস্তাব, জিম্মি মুক্তি, গাজা থেকে হামাসের নির্বাসন এবং গাজার নিরস্ত্রীকরণ।”
টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, নেতানিয়াহুর নতুন এই অবস্থান মূলত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দীর্ঘমেয়াদি মানবিক সংকট মোকাবেলার অংশ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। তবে এই কৌশল কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করছে হামাসের প্রতিক্রিয়ার ওপর।
হামাস কি রাজি হবে?
গাজার নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র সংগঠন হামাস এখনো ইসরায়েলের এই প্রস্তাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে অতীতে হামাস জানিয়েছিল— যতদিন ইসরায়েলের দখলদারিত্ব থাকবে, ততদিন তাদের প্রতিরোধ চলবে এবং অস্ত্র থাকবে তাদের হাতেই। তারা কোনোভাবেই তাদের অস্ত্র ত্যাগ করবে না কিংবা গাজা ছাড়বে না।
ফলে নেতানিয়াহুর এই নতুন শর্তে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি তা হয়ে উঠেছে আরও জটিল ও অনিশ্চিত।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন গাজার দিকে
বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহুর এই প্রস্তাব হামাসের জন্য এক ধরনের ফাঁদও হতে পারে। যুদ্ধ থামানোর সুযোগের সাথে সাথে হামাসকে একেবারে নির্মূল করাই এর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য হতে পারে। অপরদিকে, যদি হামাস এই শর্তে রাজি না হয়, তাহলে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক মহলের সামনে নিজেদের ‘শান্তিপ্রিয়’ হিসেবেই উপস্থাপন করতে পারবে।
সবমিলিয়ে, গাজার আকাশে যুদ্ধবিরতির একটি আশার আলো দেখা দিলেও, তার আড়ালে রয়েছে ভয়াবহ কূটনৈতিক দাবা খেলা। এই খেলায় পরিণতি কি হবে— তা নির্ভর করছে হামাসের পরবর্তী সিদ্ধান্তের উপর।