চট্টগ্রামে চিকিৎসা ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটলো। প্রথমবারের মতো, একটি বেসরকারি হাসপাতালে জোড়া লাগানো যমজ শিশুকে সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা হয়েছে। এই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনটি পরিচালিত হয়েছে নগরের অ্যাপোলো ইমপিরিয়াল হাসপাতালে, যেখানে শিশুর বুক ও পেটের অংশ ছিল একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত।
সাতকানিয়ার বাসিন্দা সুরাইয়া বেগম জন্ম দেন এই যমজ সন্তানদের। শিশুদুটির নাম রাখা হয়েছে রিয়াশাদ জাফর চৌধুরী ও রেনিশ জাফর চৌধুরী। জন্মের পরের দিনই, অর্থাৎ ৭ মে, সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুই নবজাতককে আলাদা করা হয়। বৃহস্পতিবার (২৯ মে) এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই বিরল ও সাহসী অস্ত্রোপচারের খবর জানায়।
অপারেশনটি পরিচালনা করেন শিশু সার্জন ডা. আদনান ওয়ালিদ, যিনি এর আগে ঢাকায় আরেকটি জোড়া লাগানো শিশুর অপারেশনে পর্যবেক্ষক হিসেবে ছিলেন। তবে এবার তিনি নিজেই পুরো চিকিৎসা দলকে নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, “এই ধরনের অস্ত্রোপচার অত্যন্ত জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। নবজাতক দুটির বুক ও পেট প্রায় আড়াই ইঞ্চি পর্যন্ত সংযুক্ত ছিল। এমনকি শ্বাসনালির একটি অংশও একসঙ্গে ছিল, যা আলাদা করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।”
এই সার্জারিতে অবেদনবিদসহ মোট ১৮ জন চিকিৎসক অংশগ্রহণ করেন এবং তিন ঘণ্টার টানা প্রচেষ্টায় অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
গর্ভাবস্থার সময় থেকেই শিশু দুটির জোড়া লাগানো অবস্থা ধরা পড়ে। ২৮ সপ্তাহে প্রথম আলট্রাসনোগ্রাফিতে বিষয়টি শনাক্ত করা হয়, এরপর আরও দুই দফা পরীক্ষায় নিশ্চিত হন চিকিৎসকরা। সেসময় এক শিশুর শরীরে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিকের চেয়ে কম পাওয়ায় বিশেষ নজরে রাখা হয়। অবশেষে ৩৪ সপ্তাহে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান দুটির জন্ম হয়।
জন্মের সময় রিয়াশাদের ওজন ছিল ৯৭৩ গ্রাম এবং রেনিশের ১০৪৫ গ্রাম। বর্তমানে ওজন বেড়ে যথাক্রমে ১২৫৫ ও ১৩৫০ গ্রামে দাঁড়িয়েছে, যা চিকিৎসকদের মতে সন্তোষজনক।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হাসপাতালের চেয়ারম্যান ওয়াহেদ মালেক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাফিদ নবী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন, ডেপুটি চিফ অব মেডিকেল সার্ভিসেস ফজল-ই-আকবর এবং অবেদনবিদ মো. মাসুদ। তারা জানান, এই অস্ত্রোপচারে ব্যয়ের পরিমাণ নির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না, তবে এটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল একটি চিকিৎসা প্রক্রিয়া।
হাসপাতালের চেয়ারম্যান ওয়াহেদ মালেক বলেন, “চট্টগ্রামে এমন একটি অপারেশন প্রথমবারের মতো সফল হওয়া আমাদের গর্বের বিষয়। আমরা প্রমাণ করেছি, এখানেও জটিল সার্জারি করা সম্ভব। তবে এই ধরনের অস্ত্রোপচারে সব সময়ই ঝুঁকি থাকে। অনেক সময় অপারেশনের পর শিশুদের বাঁচানো যায় না। কিন্তু আমাদের সন্তানেরা সুস্থ আছে, এটা আমাদের বড় প্রাপ্তি।”
শিশুদের বাবা, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী রিয়াদ জাফর চৌধুরী আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, “২৮ সপ্তাহে যখন জানলাম আমাদের শিশু দুটি জোড়া লাগানো, তখন মনে হয়েছিল পৃথিবীটা থমকে গেছে। চিকিৎসকেরা আমাদের সাহস দিয়েছেন। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব হতো না। আজ আমরা দুই সন্তানকে আলাদা ও সুস্থভাবে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছি।”
শিশুদের মা সুরাইয়া বেগম বলেন, “প্রথমে মনে হয়েছিল মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। তবে ধীরে ধীরে চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও সাহসিকতা আমাদের আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। আজ আমরা ঘরে ফিরছি দুই সুস্থ সন্তানকে নিয়ে। এটা যেন এক অলৌকিক মুহূর্ত।”
বৃহস্পতিবার বিকেলে হাসপাতাল থেকে দুই নবজাতককে নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা রয়েছে পরিবারটির। চট্টগ্রামের এই অপারেশন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই ঘটনাটি শুধুমাত্র একটি অস্ত্রোপচারের সফলতা নয়, এটি বাংলাদেশি চিকিৎসকদের দক্ষতা, সাহস ও মানবিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ভবিষ্যতে এই ধরনের আরও জটিল চিকিৎসা যেন সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়িত হয়, সেই প্রত্যাশাই সকলের।



















