close

লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!

যমুনার তীরে ১০ লাখ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

Juwel Hossain avatar   
Juwel Hossain
****

উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ জেলার প্রান্তে যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। একটি বেসরকারি ইকোনোমিক জোন, একটি বিসিক শিল্পপার্কের প্রস্তুতি অনেকটাই শেষ এবং একটি ইপিজেড তৈরির প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ওই তিন অর্থনৈতিক এলাকায় কাজ পুরোদমে শুরু হলে সিরাজগঞ্জ জেলাসহ উত্তরবঙ্গে নতুন করে প্রায় ১০ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে এবং অর্থনীতিতে আনবে বড় পরিবর্তন। সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন

ঢাকা থেকে যমুনা সেতুমুখী মহাসড়কে গিয়ে সেতু পাড় হয়ে দক্ষিণে সদর উপজেলার খাসবড়শিমুল, পঞ্চসোনা, চকবয়রা এবং বেলকুচি উপজেলার বেলছুটি ও বড়বেরা খারুয়া এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘সিরাজগঞ্জ ইকোনোমিক জোন’। ১০৪২ একর  জায়গায় গড়ে উঠছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। উদ্যোক্তাদের দাবি, এটি বেসরকারি খাতে দেশের বৃহৎ ও গ্রিন ইকোনমিক জোন।

এই ইকোনমিক জোনে জায়গা পাবে প্রায় চার শতাধিক কোম্পানি। বড় জায়গা রাখা হয়েছে বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্যও। সব কলকারখানা চালু হলে এখানে পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন (এসইজেড) ঘুরে দেখা যায়, রাস্তাঘাট নির্মাণ চলছে ও প্রকল্প এলাকার প্লট চিহ্নিতের কাজ শেষে ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান ভূমি বুঝে নিতে শুরু করেছে। কয়েকটি কারখানার ভবনের অবকাঠামো নির্মাণের কাজের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন লিমিটেডের (এসইজেডএল) পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের ইকোনমিক জোনের প্রজেক্ট অফিস চালুর পাশাপাশি কারখানা ব্লক ও রাস্তা চিহ্নিত করে মাটি ভরাটের কাজ প্রায় ৮৫ শতাংশ শেষ। ফেইজ-১ ও ফেইজ-২ এরিয়ার মাঝে একটি সেতু তৈরিও শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে কারখানার ব্লক চিহ্নিত করে উদ্যোক্তাদের প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া। মোট জমির ৬০ শতাংশ জায়গায় কারখানা তৈরির জন্য ৪০০ মতো প্লট করা হচ্ছে। বাকি জমিতে পার্ক, বনায়ন, পর্যটন সুবিধা, হাসপাতাল, আইসিটি জোন, হাটবাজার, পুকুর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গড়ে তোলা হবে। শ্রমিকদের জন্য থাকবে অত্যাধুনিক ডরমেটরি। আমরা আশা করছি, ২০২৫ সালেই এখানে প্রথম শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাবে। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সাল নাগাদ এখানে সব মিলিয়ে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা।

ব্যক্তি মালিকানাধীন ১১টি  কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠা এই ইকোনোমিক জোনে প্রায় ৪০০টির মতো প্লট তৈরি হচ্ছে। প্রকল্পের মাস্টার প্লান ও সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস (পিডব্লিউসি) এবং ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান করছে জাপান ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (জেডিআই)। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সুবিধার পাশাপাশি জল, স্থল এবং রেলপথে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের সুবিধা থাকবে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে।

মনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ইকোনোমিক জোনকে ঘিরে নদীবন্দর হচ্ছে, রেলওয়ের ইনল্যন্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) কাজ প্রায় শেষ, ট্রেনলাইন আছে, যমুনার ওপর আলাদা রেল সেতু হয়েছে (উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে), ফোর লেনের রাস্তাসহ অনেকগুলো ফ্লাইওভার হয়েছে। এছাড়া এখানে যমুনা নদীর মিষ্টিপানি আছে। যমুনা নদীর পানি ওয়াটার ট্রিপমেন্টপ্ল্যান্টে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখান থেকে ফ্যাক্টরিতে সাপ্লাই দেওয়া হবে। কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিয়েও প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে।

সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনে অনেক নামকরা কোম্পানি জমি বরাদ্দ পেয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে— অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, কন্টিনেন্টাল গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ, ডায়নামিক ড্রেজিং, নিট এশিয়া, এমকে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, রাতুল ফ্যাব্রিক, অ্যাকটিভ কম্পোজিট মিলস, রাইজিং হোল্ডিংস, রাইজিং স্পিনিং মিলস, মেরিনা প্রপার্টিজ, টেক্সট টাউন, স্কয়ার এক্সেসরিজ এবং স্কয়ার ইলেকট্রনিক্স।

ইকোনোমিক জোনের পরিচালক আরও বলেন, সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন রপ্তানিমুখী উদ্যোক্তাদের সবধরণের সুবিধা নিয়েই তৈরি হয়েছে। ১০ বছরের আয়কর রেয়াত সুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধা, কাষ্টমস বন্ডেড এলাকা হিসেবে ঘোষিত। এছাড়া সামনের দিনগুলোতে শিল্পকারখানার জন্য যেখানে সেখানে জমি পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে বিধায় ইকোনোমিক জোনে পরিবেশগত ও অবকাঠামো সুবিধার কারণে উদ্যোক্তারা বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

শুরুর দিকে চ্যালেঞ্জিং কাজ জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করার পাশাপাশি নানা প্রশাসনিক জটিলতা কাটিয়ে ইকোনোমিক জোনের বর্তমান অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন লিমিটেডের (এসইজেডএল) পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন। এছাড়া ওই অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পেছনে অতীতে বহু মানুষের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করেন তিনি।

সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্পপার্ক

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্পপার্ক’ আরেকটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় উদ্যোগ। অবকাঠামোগত কাজ শেষে এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় বিসিক শিল্প পার্ক। যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড় সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় অবকাঠামো উন্নয়ন শেষে এই পার্কে এখন প্রস্তুতি চলছে প্লট বরাদ্দের। ইতিমধ্যে আগ্রহ দেখাচ্ছেন দেশি-বিদেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তারা।

বিসিক সূত্রে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলী, পশ্চিম মোহনপুর, বনবাড়িয়া, বেলটিয়া ও মোরগ্রাম মৌজার অংশ নিয়ে প্রায় ৪০০ একর জমিতে বিসিক শিল্পপার্কটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। কলকারখানার জন্য শিল্প পার্কে নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২৭০ একর জায়গা। প্রকল্পের রাস্তা, ড্রেন ও সীমানা প্রাচীরের কাজসহ অধিকাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বিদ্যুৎ এর পিলার, চারটি সাব-স্টেশন ও গ্যাস লাইন স্থাপনের কাজও প্রায় শেষ। প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারের জন্য পুলিশ ফাঁড়ি, প্রশাসনিক জোন এবং আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে।

বিসিক সিরাজগঞ্জ জেলার দায়িত্বের থাকা সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোঃ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, শিল্পপার্কের অবকাঠামোর কাজ প্রায় শেষ, গ্যাসের মূল কানেকশন স্থাপনের পাশাপাশি বিদ্যুত সুবিধাও ইতিমধ্যে নিশ্চিত করা গেছে। খুব শীঘ্রই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ শুরু হবে বলে আশা করছি। পার্কে বিভিন্ন সাইজের ৮২৯টি প্লটে অন্তত ৫৭০টি ছোটবড় বিভিন্ন সাইজের শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরির সুবিধা থাকছে।

প্রকল্পটি সরকারের অধীনে বাস্তবায়িত হওয়াতে এখানে উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের সবধরণের সুবিধা দিতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। এই শিল্প পার্ক মহাসড়কের পাশে হওয়ায় সড়ক পথ, খুব কাছেই রেলওয়ে স্টেশন ও ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) থাকায় রেলপথের সংযোগ এবং যমুনা নদী দিয়ে নদী পথেরও একটা সংযোগ রয়েছে। যা উৎপাদন ও পণ্য পরিবহনে বিশেষ সুবিধা দেবে বলে কর্তৃপক্ষের আশাবাদ।

সিরাজগঞ্জ ইপিজেড (প্রস্তাবিত)

যমুনা নদীর একদম পাশে বিসিক শিল্পপার্কের পেছনে প্রায় ১২০০ একর জায়গা নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠতে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জ ইপিজেড। গত ২০ জানুয়ারি ২০২৫ বেপজার একটি প্রতিনিধিদল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিকল্পনা কাজে সাইট ভিজিট করেছেন বলে জানা গেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ইতিমধ্যে ওই বিশাল এলাকার মাটি ভরাট ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে সংযোগ সড়ক, গ্যাস-বিদ্যুত-পানিসহ নানা ব্যবস্থা তৈরির বিষয়গুলো এখনও পুরোটাই বাকি। প্রকল্পের সরকারি বরাদ্দ এবং সরাসরি প্রশাসনিক উদ্যোগের বিষয়ে এখনও অফিশিয়ালি কিছু জানা যায়নি। এই বিশাল এলাকায় ইপিজেড স্থাপন হলে ৫ লাখের বেশি কর্মসংস্থান সুযোগ তৈরি হবে বলে স্থানীয়দের আশাবাদ।

এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জের তরুণ ব্যবসায়ী ও ‘আমাদের সিরাজগঞ্জ’ ফেসবুক গ্রুপের অন্যতম অ্যাডমিন জিল্লুর তালুকদার বলেন, দেশের সব কলকারখানা শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে হয়, এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে ইকোনোমিক জোন ও বিসিকের এধরণের উদ্যোগ নিয়ে আমি বরাবরই আশাবাদী। আমার পূর্বপুরুষের বহু জমি যমুনা গর্ভে বিলীন হয়েছে, আবার কিছুটা জেগেও উঠেছে। সেইসব জমির অনেকটাই সিরাজগঞ্জ ইকোনোমিক জোনে ছিল, তারজন্য আমরা কিছু ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। খুব ভাল লাগছে আমাদের জেলাতে এসব জোন ও পার্ক হচ্ছে। পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেড ও নীলফামারির উত্তরা ইপিজেডের পরে উত্তরবঙ্গে সিরাজগঞ্জের ইকোনোমিক জোন, বিসিক শিল্প পার্ক ও ইপিজেড নতুন করে আশা জোগাচ্ছে। এলাকার মানুষজন নিজেদের এলাকাতেই চাকরি করতে পারবে, ভাগ্য বদলাবে উত্তরের পিছিয়ে পড়া মানুষের।

রেলওয়ে ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো, কাস্টমসের নানা কর্মসুবিধার ফলে অর্থনৈতিক প্রবাহ বাড়ার পাশাপাশি সিরাজগঞ্জের বিশাল তাঁত শিল্পের আরও বিকাশ, বৈচিত্রময় কৃষি উন্নয়ন আর নদী ভিত্তিক পর্যটনের অপার সম্ভাবনাও দেখছেন এই তরুণ ব্যবসায়ী।

ঢাকায় সাভার ইপিজেডে একটি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোহাম্মদ আলি খান বলেন, ইকোনোমিক জোন ও ইপিজেড সবসময়ই উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের নানা সুবিধা দিয়ে থাকে। সেজন্য এইসব বিশেষায়িত প্রকল্পে দ্রুত শিল্প-কারখানা হয়। আমি দীর্ঘদিন ইপিজেডে চাকরি করে দেখেছি কীভাবে আশেপাশের মানুষের ভাগ্য দ্রুত বদলায়। সিরাজগঞ্জ জেলার একজন মানুষ হিসেবে আমি খুবই আশাবাদী সিরাজগঞ্জ ইকোনোমিক জোন, বিসিক শিল্প পার্ক ও ইপিজেড নিয়ে।

সিরাজগঞ্জ ইকোনোমিক জোন, বিসিক শিল্প পার্ক ও ইপিজেডের সুযোগ-সম্ভাবনা রাজধানী এবং আশেপাশের জেলার উপরে শিল্প-কলকারখানার চাপ অনেকটাই কমাবে এবং উত্তরবঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনপদে সুষম উন্নয়ন হবে বলে আশাবাদ স্থানীয় জনগণসহ সংশ্লিষ্টদের।

לא נמצאו הערות