জাপানের দক্ষিণাঞ্চলের তোকারা দ্বীপপুঞ্জে যেন ভূমিকম্প থামছেই না। মাত্র দুই সপ্তাহে ৯০০ বারের বেশি কম্পনে এক গভীর আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ। ঘরে ফিরলেই মাটি কাঁপছে, ঘুমাতে গেলেই বুক ধড়ফড় করছে—এ যেন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।
দুর্গম তোকারা দ্বীপ ও তার আশপাশে ২১ জুন থেকে শুরু হয় এই ভূকম্পন তাণ্ডব। ২ জুলাই, বুধবার বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে ৫.৫ মাত্রার একটি শক্তিশালী কম্পন আবারও আঘাত হানে। এরপর জাপানের আবহাওয়া সংস্থা জানায়, কম্পনের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৯০০ ছাড়িয়ে গেছে।
আবহাওয়া সংস্থার ভূমিকম্প ও সুনামি পর্যবেক্ষণ বিভাগের পরিচালক আয়াতাকা এবিতা সতর্ক করে বলেন, “আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না কবে এই কম্পন থামবে। তবে বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।”
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ভূমিকম্প শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও প্রচণ্ড বিপর্যস্ত করেছে এলাকাবাসীকে। তোকারা গ্রামের এক নারী এমবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “ঘুমাতে গেলেও মনে হয় যেন মাটি কাঁপছে। বুকটা কাঁপে, এক ধরনের ভয় কাজ করে।” আরেকজন মা বলেন, “সবচেয়ে বেশি চিন্তা হয় আমার ছোট বাচ্চাদের নিয়ে। কোথায় গেলে নিরাপদে থাকব, সেটাই ভাবছি।”
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২৩ জুন একদিনেই রেকর্ড করা হয় ১৮৩টি ভূমিকম্প। ২৯ জুনে হয় ৯৮ বার, আর ৩০ জুন কম্পনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২-তে। অথচ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে যখন তোকারা দ্বীপে শেষবার এমন কম্পন দেখা গিয়েছিল, তখন মোট ভূমিকম্পের সংখ্যা ছিল ৩৪৬। এবার তা ছাড়িয়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি।
ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, তোকারা দ্বীপপুঞ্জের আশপাশের সমুদ্র অঞ্চলের ভূগঠন অত্যন্ত জটিল। মাটির নিচে যে চাপ সৃষ্টি হয়, তা সঞ্চিত হয়ে মাঝেমধ্যে একযোগে মুক্তি পায়, যা ভূমিকম্পের জন্ম দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের মাত্রা যতই ছোট হোক, ঘনঘন হওয়াটাই আতঙ্ক ছড়ানোর বড় কারণ।
প্রশান্ত মহাসাগরের 'রিং অফ ফায়ার' অঞ্চলের পশ্চিম প্রান্তে থাকা জাপান, পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর একটি। চারটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এখানে প্রতি বছর গড়ে প্রায় দেড় হাজার ভূমিকম্প ঘটে। এককভাবে পৃথিবীর মোট ভূমিকম্পের ১৮ শতাংশ ঘটে এই দেশেই।
আবহাওয়া সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসন বাসিন্দাদের প্রতি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছে। পর্যবেক্ষণ চলছে ২৪ ঘণ্টা। যদিও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর এখনও পাওয়া যায়নি, তবুও আতঙ্ক কাটছে না মানুষের মনে। ঘরবাড়ির চেয়ে এখন অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন উন্মুক্ত জায়গায়।
জাপানের তোকারা দ্বীপ যেন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করছে। প্রতি মুহূর্তেই যেন অদৃশ্য এক ভয় এসে গ্রাস করছে মানুষের মন। ভূমিকম্প কখন থামবে কেউ জানে না, কিন্তু মানুষের উদ্বেগ, আতঙ্ক আর ঘুমহীন রাত—তা কেবল বাড়ছেই।