জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের ছয় নির্ভুল পথ: যে আমলগুলো মুমিনকে পৌঁছে দিবে অনন্ত সৌভাগ্যে
মানুষের জীবনে চূড়ান্ত সফলতা হলো জান্নাতে প্রবেশ করা। কিন্তু জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ একটি বিষয় হলো—পরম সত্তা আল্লাহ তাআলাকে স্বচক্ষে দেখা। এটি এমন একটি নেয়ামত, যার তুলনায় জান্নাতের আর কোনো সুখ-সুবিধাও নিতান্তই ক্ষুদ্র মনে হবে। মুমিনরা জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভ করবে—এটি কোরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে এই মহান প্রাপ্তির জন্য কিছু বিশেষ আমল রয়েছে, যেগুলো একজন মুমিনকে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হবে। আসুন, সেই গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি আমল সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নিই—
✦ প্রথম আমল : ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করা
আল্লাহর দিদার লাভের সর্বপ্রথম ও মৌলিক শর্ত হলো ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু। একজন ব্যক্তি যদি ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল থেকে ইহজগত ত্যাগ করে, তবে কিয়ামতের দিন সে মহান স্রষ্টার দিদার লাভে ধন্য হবে। পক্ষান্তরে কাফেররা এই বিশাল নিয়ামত থেকে চিরতরে বঞ্চিত থাকবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“কখনো নয়! বস্তুত তারা সে দিন তাদের প্রতিপালকের দিদার (দর্শন) থেকে বঞ্চিত থাকবে।”
— (সুরা মুতাফফিফীন, আয়াত: ১৫)
এই আয়াতের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, ঈমানদারগণ কিয়ামতের দিন আল্লাহর দিদার লাভ করবে, আর অবিশ্বাসীরা হবে এর থেকে বঞ্চিত।
✦ দ্বিতীয় আমল : আল্লাহর কাছে দিদারের জন্য দোয়া করা
আল্লাহ তাআলার দিদার পেতে চাইলে বান্দার উচিত সরাসরি সেই প্রার্থনাই করা। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও দোয়া কবুলকারী। কায়েস ইবনে উবাদা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন একটি দোয়া করতেন, যেখানে তিনি দিদারের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতেন—
দোয়া:
“হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার দিদার লাভ করতে চাই, এবং তোমার সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষা রাখি ক্ষতিকর কষ্ট ও পথভ্রষ্টতার ফিতনা ছাড়া।”
— (সুনানে নাসায়ী, হাদিস: ১৩০৫)
এই দোয়া কেবল ভাষায় নয়, হৃদয় দিয়ে করলে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে দিদারের সৌভাগ্যে ধন্য করবেন।
✦ তৃতীয় আমল : ফজর ও আসরের নামাজ নিয়মিত আদায় করা
নামাজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ এবং আল্লাহর কাছে নিকটবর্তী হওয়ার প্রধান উপায়। বিশেষত, ফজর ও আসরের নামাজের গুরুত্ব অত্যধিক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
“তোমরা যেমন করে এই চাঁদকে দেখছ, তেমনি তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে দেখবে। তাই সূর্য উদয়ের ও অস্ত যাওয়ার সময়ের নামাজ নিয়মিত আদায় করো।”
— (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৫৪)
অর্থাৎ, এই দুটি নামাজকে নিয়মিতভাবে আদায় করা দিদার পাওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
✦ চতুর্থ আমল : গুনাহ থেকে নিজেকে দূরে রাখা
পাপ ও গুনাহ মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এমন কিছু পাপ রয়েছে, যা ব্যক্তিকে দিদারের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করতে পারে। হাদীসে এসেছে—
“আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন ধরনের মানুষের দিকে তাকাবেন না, কথা বলবেন না এবং তাদের পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।”
— (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৪)
এই তিন শ্রেণির মধ্যে আছেন—
১. যারা অহংকার করে কাপড় ঝুলিয়ে চলে,
২. দানের পর খোঁটা দেয়,
৩. এবং মিথ্যা শপথ করে ব্যবসা করে।
গুনাহ থেকে বিরত থাকা মানে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথকে প্রশস্ত করা।
✦ পঞ্চম আমল : আল্লাহর সাক্ষাতের প্রবল আকাঙ্ক্ষা রাখা
আল্লাহর দিদার লাভের জন্য অন্তরের গভীরে সেই আকাঙ্ক্ষা থাকা আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ কামনা করেন। আর যে তা চায় না, আল্লাহও তাকে চান না।”
— (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৫০৭)
এই হাদীস আমাদের শেখায় যে, আমাদের হৃদয়ে সর্বদা আল্লাহর সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা থাকা উচিত।
✦ ষষ্ঠ আমল : ইহসান বা কল্যাণকর্মে নিয়োজিত থাকা
ইহসান মানে হচ্ছে এমন আমল, যা দুনিয়াতে প্রশংসিত এবং আখিরাতে পুরস্কৃত হয়। ইহসান শুধু নামাজ-রোজা নয়, বরং মানুষের প্রতি সদাচরণ, সহানুভূতি এবং কল্যাণমুখী কাজ করাও এর অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম জুরজানি (রহ.) বলেন—
“ইহসান হলো সেই কাজ, যা দুনিয়াতে প্রশংসিত এবং আখিরাতে সওয়াবের কারণ হয়।”
এটি মুমিনের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং তাকে আল্লাহর দিদারের উপযুক্ত করে তোলে।
আল্লাহ তাআলার দিদার পাওয়া মানেই আখিরাতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করা। এটি এমন এক সম্মান, যা কেবল ঈমানদার, পরিশুদ্ধ, এবং আমলদার বান্দাদের জন্য নির্ধারিত। আমরা যেন এই মহামূল্যবান নেয়ামত থেকে বঞ্চিত না হই, সে জন্য আমাদের উচিত উপরোক্ত ছয়টি আমল হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করা ও নিয়মিত পালন করা। তাহলেই জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের পথে আমরা এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব।