একটি অসম যুদ্ধ যেন নতুন মাত্রা পেল। সামরিক পরাশক্তির দাবিদার ইসরায়েল, যাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বের সেরা বলে ধরা হয়— সেই ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করে শনিবার রাতে আঘাত হানল ইরানি ড্রোন। ইসরায়েলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এ ধরনের সফল একমুখী আক্রমণ অত্যন্ত বিরল।
এই হামলা ছিল শুধুই সামরিক নয়, ছিল কৌশলগত ও মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা। ইরানের ড্রোন দুটি যথাক্রমে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর বেইত শেইন এবং দক্ষিণাঞ্চলের এক খোলা জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটায়। CNN-এর বরাতে জানা যায়, বেইত শেইনের একটি দোতলা ভবনে বিস্ফোরণে বড়সড় গর্ত তৈরি হয় এবং জানালা-দরজা উড়ে যায়। বিস্ময়করভাবে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে এই ড্রোনগুলো সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
ইসরায়েলের ড্রোন হামলার জবাবে এক মুহূর্ত দেরি করেনি তেহরান। ১৩ জুন মধ্যরাতে ইসরায়েলের দিকে ১৫০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। এরপর থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০০টির মতো রকেট ছোড়া হচ্ছে। ইসরায়েলের দাবি, বেশিরভাগ ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র তারা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে, তবে কিছু সফল আঘাতও পৌঁছেছে লক্ষ্যবস্তুতে।
IDF (Israeli Defense Forces) জানায়, শনিবার ইরানের ছয়টি ড্রোন ধাওয়া করে তারা; এর মধ্যে দুটির সফল আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাকি চারটি গোলান মালভূমি এবং আরাভা মরুভূমির আগে প্রতিহত করা হয়।
ড্রোন হামলা এবং ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের পাশাপাশি তেহরান থেকে এসেছে আরও দুঃসংবাদ। ইসরায়েলের হামলায় দেশটির অন্যতম পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ইসার তাবাতাবেই গোমশেহ এবং তাঁর স্ত্রী নিহত হয়েছেন। এর ফলে চলমান সংঘাতে নিহত পরমাণুবিজ্ঞানীর সংখ্যা দাঁড়ালো ১০ জনে।
তেহরানের অভিযোগ, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে ইরানের বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে হত্যা করছে। একই সময়ে ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইস্পাহানের একটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েল। যদিও জাতিসংঘের পারমাণবিক সংস্থা (IAEA) এ বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।
এই ঘটনার পর ইরান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি তুরস্কে ওআইসি বৈঠকে বলেন, “ইসরায়েলি আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা হবে ভয়ংকর বিপর্যয়।” অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজ দেশের গোয়েন্দা সংস্থার ওপরই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “গোয়েন্দারা যা বলছে তা ভুলও হতে পারে।
গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ডও কিছুটা নরম সুরে বলেছেন, “ইরান কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করতে সক্ষম হতে পারে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে উভয় পক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করে উত্তপ্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ইরানের প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি বলেন, “ইসরায়েল শিশু হত্যাকারী রাষ্ট্র, যারা আন্তর্জাতিক সীমা লঙ্ঘন করে।” জবাবে ইসরায়েলি প্রতিনিধি ড্যানি ড্যানন বলেন, “ইরান বিশ্ববাসীর সামনে নাটক করছে।
বৈঠক থেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান এলেও কূটনৈতিক সমাধানের প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তেহরানের তথ্য মতে, ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত ৪৩০ জন নিহত এবং ৩,৫০০ জন আহত হয়েছে। ইসরায়েল জানায়, ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাদের ২৫ জন নিহত এবং ২,৫১৭ জন আহত হয়েছে। তবে স্বাধীনভাবে এই সংখ্যা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এখন এক বিস্ফোরণোন্মুখ বৃত্তের মতো।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত যে শুধু দুই দেশের নয়, তা প্রমাণ করেছে জাতিসংঘ থেকে ওআইসি পর্যন্ত প্রতিটি প্ল্যাটফর্ম। বিশ্বব্যাপী শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে — একটি অনিয়ন্ত্রিত সংঘাতের, যার শেষ কোথায় তা কারো জানা নেই।