রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটা। হঠাৎ বিকট এক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মুমতাহিনা খাতুনের। ইরানের রাজধানী তেহরানের আল-জাহরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে পড়াশোনা করছেন তিনি। প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি — শব্দটা কিসের? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন, কিছুক্ষণ আগেই ফজরের আজান শেষ হয়েছে। তবে মনের মধ্যে তখনো কেমন একটা অজানা ভয়।
এরই মধ্যে আবারও এক তীব্র আওয়াজ। প্রথমে ভেবেছিলেন, বুঝি বজ্রপাত! কিন্তু তেহরানের আকাশ তো পরিষ্কার — মেঘমুক্ত! বারান্দায় গিয়ে তাকাতেই দৃশ্যটা যেন সিনেমার এক ধ্বংসযজ্ঞ দৃশ্য! চোখের সামনে একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় জ্বলছে আগুন — কোথাও বিস্ফোরণ হয়েছে। রাতের নীরবতা তখন পুরোপুরি ছিন্ন করে দিয়েছে আতঙ্কিত মানুষের চিৎকার, ছুটোছুটি।
হোস্টেল তখন তুমুল আলোচনায় সরগরম। কারো মুখে ভয়, কারো মুখে কান্না, কেউ আবার ঘর ছেড়ে দৌড় দিয়েছেন খোলা মাঠের দিকে। ঠিক তখনই তৃতীয় বিস্ফোরণের শব্দ। এবার আর সন্দেহের অবকাশ রইল না — এটি একটি সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা!
চোখের সামনে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। যেই জায়গায় আগুন জ্বলছিল, তা তেহরানের ভিআইপি রিজিওন — অনেকটা বাংলাদেশের গুলশান বা বনানীর মতো। সেখানে থাকেন সামরিক বাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী, বিদেশি দূতাবাস কর্মকর্তা সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির মানুষ।
ইরান সরকারের পক্ষ থেকে পরে নিশ্চিত করা হয় — এটি ছিল ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। রেড অ্যালার্ট জারি করা হয় পুরো তেহরানে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়, বাইরে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আসে। এর মধ্যেই বাংলাদেশের রাজশাহীতে থাকা মুমতাহিনার মা খবর পান তেহরানে ইসরায়েলি হামলার কথা। সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠে কাঁপন নিয়ে মেয়েকে ফোন করেন।
মুমতাহিনা তখনো নিজেকে সামলে বলেছিলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তিন নম্বর অঞ্চলে — এখানে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবন, দূতাবাস রয়েছে। এই এলাকায় হামলার সম্ভাবনা কম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তিনিও জানতেন — যে কোনো সময় সবকিছু বদলে যেতে পারে।
পরদিন সকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয় মুমতাহিনাসহ অনেক বিদেশি শিক্ষার্থীকে। তারা রওনা হন ইরান-তুরস্ক সীমান্তের একটি শহরের দিকে — যেটা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। কিন্তু সেই পথটাও ছিল না শান্তির।
একেক জায়গায় চেকপোস্ট, কোথাও গোলাগুলির শব্দ, আবার কোথাও রাস্তায় হঠাৎ বোমা নিষ্ক্রিয় করার জন্য যানবাহন আটকে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি মুহূর্ত যেন ছিল মৃত্যুর প্রহর গোনা!
তিনি বলেন,চার দিনের সেই অভিজ্ঞতা আমি কোনো দিন ভুলব না। খাবার খেতাম ভয় নিয়ে, ঘুমাতাম চোখ আধা খুলে। মনে হতো এই বুঝি শেষ নিঃশ্বাস।
মুমতাহিনা এখন কিছুটা নিরাপদে। সীমান্তের শহরে থাকলেও দিনগুলো আতঙ্কে কাটে। তাঁর মতে, ইরানে অবস্থানরত সব বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উচিৎ এখন খুবই সতর্ক থাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয় বা দূতাবাসের নির্দেশ ছাড়া কোথাও না যাওয়া।
তিনি জানান,জীবনে প্রথম এমন ভয় পেয়েছি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে — জীবন কতটা অনিশ্চিত।
ইরানের মতো স্পর্শকাতর একটি দেশে এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর এই রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা যেন কেবল একটি যুদ্ধের গল্প নয় — এটি সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি, ভয়ের মধ্যেও টিকে থাকার এক অব্যক্ত যুদ্ধ। মুমতাহিনার মতো আরও অনেক বিদেশি শিক্ষার্থীর জীবনে এই চার দিন হয়ে থাকবে চিরস্মরণীয় — এক কালো অধ্যায়, যা শুধু তার মায়ের কণ্ঠেই নয়, কেঁপে উঠিয়েছে হাজারো মানুষের হৃদয়।