ইরানের মাটিতে ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলার গল্প শুরু হয় সাধারণ আকাশপথের বাইরে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলার মূল কৌশল ছিল স্থলপথ ও গভীর গোয়েন্দা তৎপরতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক বিস্তৃত গোপন নেটওয়ার্ক। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিল এই নিখুঁত অভিযানের জন্য, যা ছিল এক ধরনের গুপ্তচরবৃত্তির জটিলতর মিশ্রণ।
ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী ইসরাইলি অনুপ্রবেশের বিষয়ে পূর্বেই সতর্ক থাকলেও, মোসাদের হাত ধরে গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠার ফলে ইরানের গোয়েন্দা সক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং কিছু ইসরাইলি কর্মকর্তার বক্তব্য থেকে জানা গেছে, ইরানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু যেমন ‘অ্যান্টি সাবমেরিন সিস্টেম’, ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার, কমান্ড সেন্টার এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের ওপর একযোগে হামলা চালানো হয়েছিল।
এই ধরনের পরিকল্পিত হামলা শুধুমাত্র অভ্যন্তরে সক্রিয় গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে সম্ভব—যা মোসাদের দক্ষতার পরিচায়ক। সামরিক ও গোয়েন্দা পর্যালোচকরা মনে করেন, এই হামলার কারণে ইরানের গোয়েন্দা ব্যবস্থা মারাত্মক দুর্বল হয়েছে, যার প্রভাব দেখা দিয়েছে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও আতঙ্কের সৃষ্টি।
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড হামলার পঞ্চম দিনে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক করে মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ ও ল্যাপটপের মতো নেটওয়ার্ক সংযুক্ত ডিভাইস ব্যবহার কমানোর নির্দেশ দেয়। এই সতর্কবার্তা কেবল কর্তৃপক্ষের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও সাইবার ঝুঁকির আশঙ্কা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, এই সতর্কতাগুলো ইরানের সাইবার নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ভয়াবহতারই প্রতিফলন। একই সাথে, ইসরাইলের গোপন অপারেশনগুলো ইরানের ভেতরে অস্ত্র চোরাচালান, অস্ত্র উৎপাদন ও সমাবেশের জন্যও নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল।
পশ্চিমা ও ইসরাইলি সূত্রে জানা যায়, মোসাদের স্থানীয় অ্যাজেন্টরা ইরানের বিভিন্ন এলাকায় গোপন ঘাঁটি তৈরি করেছিল, যেখানে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি ও সংরক্ষণ করা হতো। বিশেষ করে তেহরানের কাছে একটি তিনতলা ভবন ছিল আত্মঘাতী ড্রোন তৈরির ঘাঁটি।
গত কয়েক বছরে এই ঘাঁটিগুলো তৈরি ও পরিচালনা করে মোসাদের সদস্যরা। নিরাপত্তা বাহিনী দু’টি অভিযানে মোসাদের সাথে সংশ্লিষ্ট দুই ‘অ্যাজেন্ট’কে গ্রেফতার করেছে, যাদের কাছ থেকে বিস্ফোরক ও ড্রোন যন্ত্রাংশ উদ্ধার করা হয়।
ইরানের পরমাণু স্থাপনা ইসফাহানে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ড্রোন তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করেছে এবং এই ঘটনায় চারজনকে আটক করা হয়েছে।
ইসরাইলের এই গোপন অভিযানে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক, হালকা ওজনের, রিমোট কন্ট্রোলযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র, যা অপারেটরের উপস্থিতি ছাড়াই ইরানের ভেতর থেকে হামলা চালাতে সক্ষম। ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন ‘স্পাইক মিসাইল লঞ্চার’ উদ্ধার করেছে, যেগুলো বিশেষভাবে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য তৈরি।
এসব লঞ্চার ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল গাইডেন্স, ক্যামেরা ও স্যাটেলাইট যোগাযোগ সিস্টেমে সজ্জিত ছিল। মোসাদের অ্যাজেন্টরা এগুলো পরিচালনা করছিলেন।
ইসরাইলের হামলার প্রথম ধাপে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করার জন্য ছোট আত্মঘাতী ড্রোন, গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ও ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধ ব্যবহার করা হয়। লক্ষ্য ছিল ইরানের রাডার সিস্টেম ও প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র প্ল্যাটফর্ম ধ্বংস করা, যাতে ইসরাইলের বিমান হামলার জন্য নিরাপদ করিডোর তৈরি হয়।
হামলার প্রথম দিনেই মোসাদের কমান্ডোরা ইরানি ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে এবং নিরাপদ স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল বলে খবর আসে।
ইসরাইলি হামলার আরেকটি লক্ষ্য ছিল ইরানের সামরিক ও রেভল্যুশনারি গার্ডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সরাসরি নিশানা করা। মোসাদের দল গোপন তথ্য ও স্মার্ট অস্ত্রের মাধ্যমে ইরানের ‘চেন অফ কমান্ড’ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছে, যাতে সামরিক প্রস্তুতি দুর্বল হয়।
এই হামলার মাধ্যমে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাড়ি ও অফিসগুলোই মূলত লক্ষ্যবস্তু ছিল, সামরিক ঘাঁটি নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলের এই হামলা ছিল বছরের পর বছর তথ্য সংগ্রহ, রিয়েল-টাইম মনিটরিং ও নিখুঁত লক্ষ্য নির্ধারণের ফসল। হামলা চলাকালীনও মোসাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত ছিল।
এছাড়া, হামলার সময়ই রেভল্যুশনারি গার্ডের গুরুত্বপূর্ণ প্রধান এবং তার ডেপুটি লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল, যাদের ওপর একাধিক নিশানা করা হয়।
সংক্ষেপে, মোসাদের দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা, আধুনিক স্মার্ট অস্ত্র ও রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তির সমন্বয়ে ইসরাইল ইরানের ভিতর থেকে এক নিখুঁত এবং পরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে, যা ইরানের সামরিক ও গোয়েন্দা সক্ষমতাকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।



















