ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য। এমন পরিস্থিতিতে ইরান হুমকি দিয়েছে—বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে। যদি এই প্রণালি বন্ধ হয়, বাংলাদেশসহ জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশগুলোর জন্য শুরু হবে এক ভয়াবহ সংকটের সময়।
বিশ্লেষকদের মতে, হরমুজ প্রণালি বিশ্ব জ্বালানির প্রবাহের প্রাণকেন্দ্র। পারস্য উপসাগর ও আরব সাগরকে সংযুক্ত করা এই প্রণালির উপর নির্ভর করে দৈনিক ১৮ থেকে ১৯ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল ও বিপুল পরিমাণ এলএনজি পরিবহন। ইরান যদি এই পথ বন্ধ করে দেয়, তাহলে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৫০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
বাংলাদেশ কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করে। এই আমদানি কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে হরমুজ প্রণালির উপর নির্ভরশীল। ফলে এই পথ বন্ধ হলে বাংলাদেশে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা খুব ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ কাতার এনার্জি ও ওকিউ ট্রেডিং থেকে ১৫ বছর মেয়াদি এবং ১০ বছর মেয়াদি এলএনজি আমদানির চুক্তি কার্যকর রেখেছে। কাতার থেকে বছরে প্রায় ৪৩ লাখ টন ও ওমান থেকে প্রায় ১২-১৫ লাখ টন গ্যাস আসে।
ইরান-ইসরাইল উত্তেজনার পর বিশ্ববাজারে ইতোমধ্যে ব্রেন্ট ক্রুড এর দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৭৪.৫৬ ডলার এবং ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI) ৭০.৩৭ ডলার। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বাজারে। পরিবহন ব্যয় বাড়বে, শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি হুহু করে বাড়বে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানিয়েছেন, “তেলের দাম বাড়লে পোশাক খাত থেকে শুরু করে সকল রপ্তানিমুখী খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে, সাধারণ মানুষও চাপে পড়বে।”
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বাজারেও ইতোমধ্যে ধস দেখা দিয়েছে। ডাও জোন্স সূচক একদিনেই কমেছে প্রায় ৮০০ পয়েন্ট। মূল্যবান ধাতু ও মুদ্রায় বিনিয়োগের চাহিদা বাড়ছে—সোনার দাম বেড়েছে ১ শতাংশের বেশি এবং মার্কিন ডলারের মান বৃদ্ধি পেয়েছে।
জেপি মর্গান পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে যদি ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ে, তাহলে জ্বালানি তেলের দাম ১৫০ ডলার পর্যন্ত যেতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির চরম পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানিয়েছেন, “জ্বালানি সংকট আমাদের দুইভাবে আঘাত করবে—একদিকে গ্যাসের ঘাটতি শিল্প উৎপাদন ব্যাহত করবে, অন্যদিকে পরিবহন ব্যয়ের কারণে রপ্তানিপণ্যের দাম বাড়বে। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে এখনই বিকল্প জ্বালানি উৎস খুঁজে বের করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্ভাব্য উৎসের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধানেও জোর দিতে হবে।
ইরান ও ইসরাইলের সংঘাত কেবল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের শিরায় রক্তচাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে এই সংঘর্ষ। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশে এর প্রভাব পড়বে সর্বত্র—পেট্রোল পাম্প থেকে রান্নাঘর, শিল্প কারখানা থেকে শেয়ার বাজার পর্যন্ত। সময় থাকতে সমন্বিত কৌশল না নিলে, সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন সময়।