বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ প্রধান রপ্তানিপণ্যগুলো এখন ভারতের বাজারে প্রবেশে বড় বাধার মুখে। হঠাৎ করেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় স্থলবন্দরগুলো দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করেছে দিল্লি। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা একে দুই দেশের মধ্যকার এক নতুন উত্তেজনার সূচনা হিসেবে দেখছেন।
সূত্র বলছে, এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে রয়েছে চীন সফরে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের একটি মন্তব্য। তিনি সম্প্রতি চীনের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে “ল্যান্ডলকড” বা সমুদ্রবন্দরবিহীন এলাকা হিসেবে উল্লেখ করেন। এই বক্তব্য দিল্লির কূটনৈতিক ও বাণিজ্য মহলে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
ভারতের পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ড. ইউনুসের মন্তব্যকে “অসম্মানজনক, ভুল তথ্যনির্ভর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” আখ্যা দিয়ে বলেছে, এতে ভারতের আঞ্চলিক সংযোগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নের অর্জনগুলোকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের দাবি, এমন বক্তব্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার একটি কৌশল।
যেসব বন্দর এখন বন্ধ
নতুন এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরামসহ পশ্চিমবঙ্গের ফুলবাড়ি এবং চ্যাংরাবান্ধা স্থলবন্দর। এসব বন্দর দিয়েই বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পণ্য ভারতে রপ্তানি করে থাকে। তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, খাদ্যপণ্য, হালকা প্রকৌশল সামগ্রী—সবই এই রুটে যেত।
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্থলবন্দরগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ৯৩ শতাংশ রপ্তানি ভারতে পাঠাত। ফলে এই রপ্তানি কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অর্থনৈতিক ধাক্কা।
ব্যবসায়ী মহলে উৎকণ্ঠা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত আকস্মিক এবং বিপর্যয়কর। একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠন বলছে, আগেই ন্যূনতম মূল্যনির্ধারণ, উচ্চ শুল্ক আর নিয়ম জটিলতার কারণে ভারতে পণ্য রপ্তানিতে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল—এখন সেই পথ পুরোপুরি রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
একজন সিনিয়র ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা ভারতের বাজারে প্রবেশের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছিলাম। কিন্তু এখন এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিল।”
কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী?
সরকারিভাবে এখনো বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং দ্রুতই ভারতে কূটনৈতিক বার্তা পাঠানো হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনুসের বক্তব্য কূটনৈতিকভাবে ‘আনপ্রফেশনাল’ হলেও তার ভিত্তিতে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে নেওয়া হলে তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সামনের দিনগুলোতে কী ঘটতে পারে?
বিশ্লেষকদের একাংশ আশঙ্কা করছেন, যদি এ নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে তা শুধু পোশাক শিল্পই নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি ভারতের প্রতি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আস্থাও নষ্ট হতে পারে।
অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করছেন, এটি একটি কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল, যা কিছুদিনের মধ্যেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়ে যাবে। তবে সেটি নির্ভর করছে দুই দেশের সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতার ওপর।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, কূটনৈতিক সংযম ও দক্ষতা প্রদর্শন করা। কারণ একতরফা কোনো সিদ্ধান্তেই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসে না। ড. ইউনুসের বক্তব্য নিয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা ও পরিস্থিতি নিরসনের জন্য উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক উদ্যোগ সময়ের দাবি।



















