মধ্যপ্রাচ্য আবারো উত্তপ্ত! পারস্য উপসাগরে হরমুজ প্রণালী ঘিরে ফের সামরিক উত্তেজনা চরমে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ইসরায়েলের ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানি সেনাবাহিনী গোপনে স্ট্রেইট অব হরমুজ বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ জন্য তাদের সামরিক জাহাজে মাইন লোড করার প্রমাণও হাতে এসেছে বলে দাবি করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
এই ঘটনায় পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ বিশ্ববাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ পথ, যার মাধ্যমে দৈনিক বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস সরবরাহ হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ইসরায়েলের ১৩ জুনের হামলার ঠিক পরপরই ইরান এই সামরিক প্রস্তুতি নেয়।
দুজন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে নিশ্চিত করেন, ১৩ জুন ইরানের জাহাজে মাইন লোড করার বিষয়টি প্রথম নজরে আসে। তবে তারা জানান, এখনো পর্যন্ত কোনো মাইন স্থাপন করা হয়নি। যদিও এই প্রস্তুতি নিজেই ইরানের পক্ষ থেকে একটি ‘শক্ত বার্তা’ হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বের প্রায় ২০% তেল ও গ্যাস সরবরাহ হয় হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে। এটির চলাচল ব্যাহত হলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো পৃথিবীর জ্বালানি বাজার ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান যদি সত্যিই প্রণালীটি বন্ধ করত, তবে তেলের দামে লাগামছাড়া বৃদ্ধি হতো, যা বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ও জ্বালানি ঘাটতির মতো চ্যালেঞ্জ তৈরি করত।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এই গোয়েন্দা তথ্য অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং আগে কখনো প্রকাশিত হয়নি। এক্ষেত্রে তারা কোনো ধরণের সম্ভাব্য ছলচাতুরির আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
তাদের মতে, ইরান হয়তো কৌশলগত কারণে এই বার্তা দিতে চাচ্ছিল যে, তারা প্রয়োজনে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করতে প্রস্তুত। তবে এটি প্রকৃত সামরিক প্রস্তুতিও হতে পারে, যদি দেশটির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এমন নির্দেশনা দিত।
২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ইরানের কাছে রয়েছে ৫,০০০-এর বেশি নৌ মাইন, যা দ্রুত স্থাপন করার জন্য বিশেষ ছোট ও উচ্চগতির নৌযান ব্যবহার করে থাকে তারা।
এই সক্ষমতার কারণে ইরান বহুদিন ধরেই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার হুমকি দিয়ে আসছে। তবে বাস্তবে এখনো কখনোই তারা সেই পদক্ষেপ নেয়নি।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার মধ্যেই, ২২ জুন ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার একটি প্রস্তাবে সমর্থন দেয়। যদিও এটি বাধ্যতামূলক ছিল না, এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভার ছিল সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদের ওপর।
ওপেক সদস্য দেশ যেমন সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক এবং কাতার — সবাই তাদের তেল ও গ্যাস রপ্তানির জন্য হরমুজ প্রণালী ব্যবহার করে। এমনকি ইরান নিজেও এই পথেই অধিকাংশ তেল রপ্তানি করে থাকে।
ফলে, প্রণালী বন্ধ হলে ইরান নিজেও ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে।
হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সরু অংশ মাত্র ২১ মাইল চওড়া, যার মধ্যে মাত্র ২ মাইল পথ দুইদিকের জাহাজ চলাচলের জন্য ব্যবহার করা যায়। ফলে সামান্য একটি সামরিক পদক্ষেপেও পুরো প্রণালী অচল হয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর বাহরাইনে অবস্থান নেয় এবং পুরো পারস্য উপসাগরের বাণিজ্যিক চলাচল রক্ষায় কাজ করে।
ইরানে সম্ভাব্য প্রতিশোধের আশঙ্কায়, তারা ইতোমধ্যে ওই অঞ্চলের সব অ্যান্টি-মাইন জাহাজকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে।
হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নেতৃত্বে “অপারেশন মিডনাইট হ্যামার” এবং হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সফল অভিযানের কারণে হরমুজ প্রণালী এখনো উন্মুক্ত রয়েছে। তার ভাষায়, “ইরান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং হরমুজ এখনো নিয়ন্ত্রণে।
এখনো পর্যন্ত ইরানের জাতিসংঘ মিশন কিংবা মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, বিষয়টি কেবল মধ্যপ্রাচ্যের নয় — বরং পুরো পৃথিবীর অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। কারণ হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে জ্বালানি সরবরাহে যে সঙ্কট তৈরি হবে, তা দ্বিতীয় কোনো যুদ্ধের চেয়ে কম ভয়াবহ হবে না।