১ জুলাই ২০১৬। একটি সাধারণ শুক্রবার সন্ধ্যায় গুলশান-২-এর কূটনৈতিক এলাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে শুরু হয় ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। ঠিক ৯ বছর আগে আজকের দিনেই, নিরাপদ মনে করা একটি অভিজাত রেস্তোরাঁ মুহূর্তেই পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
সন্ধ্যার পরপরই কালো পোশাকে, হাতে অস্ত্র নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢোকে পাঁচজন তরুণ জঙ্গি। তারা মুহূর্তেই স্থানীয় ও বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে ফেলে। রক্তাক্ত সেই রাতে প্রাণ হারান ২২ জন নিরীহ মানুষ, যাঁদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন বিদেশি নাগরিক—ইতালি, জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের।
জঙ্গিদের প্রতিরোধে ঘটনাস্থলে আসা দুই পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন তাদের ছোড়া গ্রেনেডে। ওই মুহূর্তে গোটা দেশ নিস্তব্ধ, হতবাক—হঠাৎ করে এমন বর্বরতার শিকার হবে বাংলাদেশ, কেউ কল্পনাও করেনি।
প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে জিম্মি দশা চলার পর ভোররাতে সেনাবাহিনীর স্পেশাল কমান্ডো ইউনিট ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে। দুঃসাহসিক অভিযানে পাঁচ হামলাকারী নিহত হয় এবং ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
ওই রাতেই হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। যদিও বাংলাদেশ সরকার তা অস্বীকার করে জানায়, দেশীয় জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি-ই এই হামলার নেপথ্যে ছিল।
এই হামলার মামলাটি বিচারিক প্রক্রিয়ায় দুটি ধাপ পেরিয়েছে।
২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল নব্য জেএমবির সাত সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
এরপর হাইকোর্ট ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেন এবং সেই রায়ে সাতজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
২০২৫ সালের জুনে দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামি লিভ টু আপিল করেন। আপিল বিভাগে শুনানি এখনো চলমান।
আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন:
১. রাকিবুল হাসান রিগ্যান
২. জাহাঙ্গীর হোসেন রাজীব গান্ধী
৩. হাদিসুর রহমান
৪. আবদুস সবুর খান সোহেল মাহফুজ
৫. মামুনুর রশীদ রিপন
৬. শরিফুল ইসলাম খালেদ
৭. আসলাম হোসেন র্যাশ (যিনি ২০২৪ সালে কারাগারে নিহত হন)
কারাগারে গণ-অভ্যুত্থানের সময় কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে বন্দিদের হামলায় আসলাম নিহত হন। এ সময় জেল থেকে পালিয়ে যায় ২০৯ জন বন্দি এবং প্রাণ হারায় ৬ জন।
১৭ জুন প্রকাশিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়,
নব্য জেএমবি নামধারী একটি নিষিদ্ধঘোষিত উগ্র সংগঠন এই হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে। ফরেনসিক, ডিএনএ, স্বীকারোক্তি, ব্যালিস্টিক ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থেকে সন্দেহাতীতভাবে তা প্রমাণিত হয়েছে।
আসামিদের ‘একই অভিপ্রায়’ থাকলেও সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি—এই কারণে তাদের মৃত্যুদণ্ড রদ করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হোলি আর্টিজান বেকারি এখন আর নেই। ঘটনার পরপরই মালিকপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় এটি আর খোলা হবে না। বর্তমানে জায়গাটি একটি আবাসিক ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে।
তবে যে দেয়ালে ওই রাতের রক্ত জমে ছিল, যে মেঝেতে পড়ে ছিল মৃতদেহ—সেসব চিহ্ন আজও হয়তো অনেকের মনে আঁকা হয়ে আছে। প্রতি বছর এই দিনে নিহতদের পরিবার, স্বজন এবং সাধারণ মানুষ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করে সেই রাতের নৃশংসতা।
হোলি আর্টিজান হামলা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন জঙ্গি হামলা নয়, বরং তা ছিল জাতির অস্তিত্বের ওপর সরাসরি আঘাত।
নিহতদের রক্ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আত্মত্যাগ, বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘ লড়াই—সবকিছুই এই ঘটনায় এক ভয়ঙ্কর ও শিক্ষণীয় ইতিহাস তৈরি করেছে।