বাউফল, পটুয়াখালীর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা, যা রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং দলীয় কর্মকাণ্ডের জন্য বরাবরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। এই অঞ্চলের রাজনীতি কেবল নির্বাচনী লড়াই বা দলীয় শক্তির প্রদর্শন নয়, বরং মানুষের আবেগ, প্রত্যাশা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠারও প্রতিচ্ছবি। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বিএনপির এক বিশাল জনসমাবেশে সাবেক এমপি সহিদুল আলম তালুকদারের বক্তব্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি একদিকে দলের ঐক্য এবং তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন, অন্যদিকে স্থানীয় সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কড়া বার্তা দিয়েছেন হলুদ সাংবাদিকতা না করার জন্য।
বিএনপির উদ্যোগে আয়োজিত এই জনসমাবেশটি ছিল শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক সমাবেশ নয়, বরং এটি ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসা এবং আস্থার প্রতিচ্ছবি। সহিদুল আলম তালুকদার তার বক্তব্যে বলেন, “আমার কাছে টাকা নেই, কিন্তু ভালোবাসা আছে। আমাকে তারা ভালোবাসে বলেই আজকের জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে।” সত্যিই, বাউফলের পাবলিক মাঠে উপস্থিত হাজারো নেতাকর্মী এবং সাধারণ জনগণের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে যে অর্থের চেয়ে মানুষের ভালোবাসা অনেক বড়।
জনসমাবেশে সহিদুল আলম তালুকদার কেবল দলের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাই বলেননি, তিনি প্রশাসনের কার্যকলাপ নিয়েও কঠোর সমালোচনা করেছেন। বাউফলের ইউএনও এবং থানার ওসিকে সরাসরি সমালোচনা করে তিনি বলেন, “মানুষ বিপদে পড়লেও দরজা খুলেন না। এভাবে হলে চলবে না।” এছাড়াও পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনায় পুলিশের নির্লিপ্ততা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “কার পোস্টার কে ছিঁড়েছে তার কোনো হদিস নেই। আপনি ছেঁড়া পোস্টারের ছবি আমার কাছে পাঠিয়েছেন। তাকে খুঁজে বের করুন, শাস্তি দিন। সে আমার লোক হলেও আপত্তি নেই।” এই বক্তব্যগুলো বাউফলের প্রশাসনিক দৌরাত্ম্য এবং স্থানীয় রাজনীতিতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
সহিদুল আলম তালুকদার তার বক্তব্যে দলের গর্ব এবং অহংকার হিসেবে তারেক রহমানের নাম উচ্চারণ করে বলেন, “তার হাতকে শক্তিশালী করতে সকল বিভেদ ভুলে এক হতে হবে।” তারেক রহমানের ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই পরিকল্পনাগুলো কেবল দলের জন্য নয়, বরং দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। তারেক রহমানের ৩১ দফার মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, এবং মানবাধিকারের বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে, যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সবচেয়ে আলোচিত অংশ ছিল সহিদুল আলম তালুকদারের সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্য। তিনি বলেন, “আপনারা যে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে পারেন, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি তখন আসবে যখন আপনারা পক্ষপাতিত্ব করবেন। আপনারা হলুদ সাংবাদিকতা করবেন না। তা হলে পরিণতি ভালো হবে না।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা থাকলেও এর অপব্যবহার কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।
হলুদ সাংবাদিকতা বলতে বোঝায় এমন সাংবাদিকতা যা তথ্যের যথার্থতা বা নিরপেক্ষতা বজায় না রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা প্রভাবিত হয়ে খবর প্রকাশ করে। এটি কেবল সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতা ক্ষুণ্ণ করে না, বরং সমাজে বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সহিদুল আলম তালুকদারের এই বক্তব্য স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা যে, নিরপেক্ষতা বজায় রাখাই হবে প্রকৃত সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি।
সহিদুল আলম তালুকদারের এই বক্তব্যের পর বাউফলের সাংবাদিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেক সাংবাদিক মনে করছেন, এটি তাদের কাজের স্বাধীনতার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে, কিছু সাংবাদিক সহমত প্রকাশ করে বলেছেন যে, নৈতিকতা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সত্যিই সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। “সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হলো সত্য এবং নিরপেক্ষতা। আমরা কোনো পক্ষপাতিত্ব করবো না, তবে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।
সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তসলিম তালুকদার, পটুয়াখালী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সালমা আলম লিলি, বিএনপির সাবেক ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক প্রভাষক মাসুদুর রহমান, যুব দলের আহ্বায়ক জসিম উদ্দিন, উপজেলা ছাত্র দলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক তৌসিফুর রহমান রাফা, এবং পৌর ছাত্র দলের সাবেক আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল ফাহাদ। বক্তারা সবাই বিএনপির পকেট কমিটি বাতিলের দাবি তুলে ধরেন এবং দলের মধ্যে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।
এই জনসমাবেশ এবং সহিদুল আলম তালুকদারের বক্তব্য বাউফলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে তিনি কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমালোচনা করেননি, বরং নিজের দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকেও ইঙ্গিত দিয়েছেন। হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে তার কড়া বার্তা এবং প্রশাসনের অবহেলার বিষয়ে তার সরাসরি সমালোচনা বাউফলের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সহিদুল আলম তালুকদারের বক্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, রাজনীতি এবং সাংবাদিকতা উভয়েরই মূল ভিত্তি হলো সত্য এবং ন্যায়বিচার। রাজনীতিবিদদের মতো সাংবাদিকদেরও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে সমাজে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া এবং কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব বা প্রভাবিত না হয়ে কাজ করা। বাউফলের এই জনসমাবেশ কেবল একটি রাজনৈতিক সমাবেশ নয়, এটি ছিল মানুষের ভালোবাসা, ন্যায়ের প্রতি প্রত্যাশা এবং সমাজের স্বচ্ছতার জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা।
সর্বশেষে বলা যায়, বাউফলের এই জনসমাবেশ এবং সহিদুল আলম তালুকদারের বক্তব্য বাউফলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, এই বক্তব্যের প্রভাব স্থানীয় প্রশাসন, সাংবাদিকতা এবং দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, সত্য এবং ন্যায়ের পথে থেকে সাংবাদিকতা এবং রাজনীতির সম্মিলিত প্রচেষ্টাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
No comments found



















